বঙ্গবন্ধু তুমিই স্বাধীনতা, তুমিই বাংলাদেশ

একটা জাতির অভ্যুদয়ের গল্প শোনাবো। সেই গল্প লেখা হয়েছে রক্তের কালিতে। এই গল্পে আছে নয় মাসের যুদ্ধ, সীমাহীন ত্যাগ, দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত, ত্রিশ লাখ মানুষের প্রাণ এবং একজন মহাপুরুষের কাহিনী। যে মহাপুরুষের ডাকে ফিনিক্স পাখির মতো ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সেই জাতি। যে মহাপুরুষকে তুলনা করা হয় হিমালয়ের সাথে। সেই জাতির নাম বাঙালি জাতি, দেশের নাম বাংলাদেশ এবং মহাপুরুষের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা খোকা নামের ছেলেটি একসময় হয়ে উঠেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যপুরুষ, একটি স্বাধীন জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা। বাংলাদেশের প্রতিটি মুক্তি আন্দোলনে ছিল তাঁর গৌরবময় পদচারণা। পাহাড়সম ব্যক্তিত্বের অধিকারী এ মানুষটি কখনো হেরে যাননি, মাথা নত করেননি অন্যায় অত্যাচারের কাছে। নির্মম নিষ্পেষনে পিষ্ট দিশেহারা জাতির জন্য বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।
১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্ম নেয়া বঙ্গবন্ধু ছাত্রাবস্থা থেকেই রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ছাত্র অধিকার আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭ই মার্চের মঞ্চ, সবগুলো ধাপে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অটল এক মনোবলের অধিকারী। তিনি জানতেন এ দেশের মানুষকে মুক্ত করার উপায় একটাই। সেটা হলো স্বাধীনতা। ৪৭-এর দেশভাগের পরে পাকিস্তান নামের একটা দেশ সৃষ্টি হলো। পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান দুটো আলাদা প্রদেশ ছিলো। শুরু থেকেই বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানিদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানিরা শুরু করে নির্যাতন আর বঞ্চনা। চাকরি, অর্থনীতি, নাগরিক সেবা দূরের কথা, তারা কেড়ে নিতে চাইলো মাতৃভাষা বাংলাকে। শুরু হলো প্রতিবাদ। তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠিত করতে থাকলেন ছাত্র জনতাকে। গঠিত হলো বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। শুধু সংগঠিত করাই নয়, বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন মাঠের সৈনিক। ভাষা আন্দোলনের সময় ডাকা হরতাল থেকে পিকেটিং করা অবস্থায় তাঁকে গ্রেফতার করা হল। দমে গেলেন না তিনি। জেলে বসেই শুরু করলেন নতুন পরিকল্পনা। জেল থেকেই তাঁর প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি আম্রকানন থেকে বের হয় বিরাট মিছিল। সেই মিছিলে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় দেশপ্রেমিক কয়েকজন অকুতোভয় সন্তানকে। শহীদদের রক্ত সারা দেশে বইয়ে দেয় আন্দেলন আর প্রতিবাদের বন্যা। পিছু হঠতে বাধ্য হয় দখলদারেরা। মুক্ত হোন বঙ্গবন্ধু।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, বাঙালির মুক্তির সনদ ১৯৬৬ এর ছয়দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়, প্রতিটি অধ্যায়ই ছিলো বাঙালি জাতির মুক্তির পথে একেকটি সোপান। দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী যখন গণতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়, বঙ্গবন্ধু ডাক দেন মুক্তির আন্দোলনের। জেনারেল ইয়াহিয়া ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ সংসদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ১ মার্চ অধিবেশন স্থগিত করা হয়। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সারা পূর্ব পাকিস্তান। ৩রা মার্চ সারাদেশে পালিত হয় স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল কর্মসূচী। পাকিস্তানিরা বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা আঁটতে থাকে। বঙ্গবন্ধু জানতেন, তাঁর প্রিয় মানুষগুলোর উপর নেমে আসতে চলেছে নির্মম এক নিষ্পেষনের খড়্গ। তাই তিনি ৭ই মার্চের সমাবেশ ডাক দিলেন। পাকিস্তানিদের শত বাধা উপেক্ষা করে রেসকোর্সে জড়ো হতে লাগলো মুক্তিকামী লক্ষ জনতা। তাঁদের সবার চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন, বুকে দেশমাতার প্রতি অসীম ভালোবাসা।
বেলা দুটো পঁয়তাল্লিশে ‘কল রেডি’ মাইকের সামনে এসে দাঁড়ালেন বাঙালি জাতির হিমালয়। শুরু করলেন ভাষণ। এটা শুধু ভাষণ নয়, এটা ছিলো মুক্তির আহ্বান, স্বপ্নের দিকে ছুটে যাওয়ার দিকনির্দেশনা। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বললেন তাঁর প্রিয় দেশের মানুষের রক্তে রাজপথ লাল হওয়ার কথা, বললেন কিভাবে পাকিস্তানিরা বছরের পর বছর বঞ্চিত করে গেছে বাঙালি জাতিকে, গুলির বিরুদ্ধে উচ্চারণ করলেন প্রতিবাদের তীব্র ধ্বনি।
বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল- প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ তাঁর এই কথাটি ছিলো স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে প্রত্যক্ষ আহ্বান। ভাষণের শেষের দিকে তিনি বজ্রকন্ঠে বললেন,
‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধুর এই কথা শুনে সাত কোটি মানুষের রক্ত যেন টগবগ করে ফুটে উঠল। সবাই তখন বুঝে গেছেন বঙ্গবন্ধু কি বোঝাতে চেয়েছেন। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লেন যুদ্ধে। নয়মাসের রক্তগঙ্গায় ভেসে বিজয়ের তরী ভিড়লো বাংলাদেশে। পরাধীনতার শিকল ভেঙে মুক্ত হলো একটা জাতি।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১, এই তেইশ বছরের স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বশেষ সোপান ছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ।এর ঠিক পূর্বে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ ছিল জাতির যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনন্য এক নিয়ামক। তাই ঐতিহাসিকভাবে এই ভাষণের তাৎপর্য অসামান্য। এই ভাষণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে ডাকা হয় রাজনীতির কবি। ২০১৭ সালে ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণকে ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। একটি ভাষণ কিভাবে মুক্তিকামী মানুষকে পথ দেখাতে পারে, এর অনন্য উদাহরণ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ। একটা সাহসী তর্জনি যেন ছিল মুক্তিযুদ্ধের অশেষ প্রেরণা!
বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধুকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তাঁর সারা জীবনের কাজের স্বীকৃতি আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশ।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট দেশবিরোধী কুচক্রীদের হাতে সপরিবারে নিহত হলেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানিরা যাঁকে হত্যা করতে ভয় পেয়েছিলো, সেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলো কিছু বিপথগামী সেনা সদস্য। তবু মৃত্যুর প্রায় অর্ধশতাব্দী পরেও যেন বাংলাদেশের প্রতিটি ধূলিকণায় লেখা আছে বঙ্গবন্ধুর নাম। বাংলাদেশ নামক মাতাকে এখন আমরা গর্ব করে বলতে পারি আমাদের একজন বঙ্গবন্ধু ছিলেন, যিনি শুধু স্বাধীনতার স্বপ্নই দেখেননি, নিরলস কাজ করে গেছেন সেই স্বাধীনতা অর্জনের পথে। যে উজ্জ্বল দীপশিখা তাঁর হৃদয়ে জ্বলে উঠেছিল, বঙ্গবন্ধু সেই দীপশিখার আলো বিলিয়ে দিয়েছিলেন সাত কোটি মুক্তিকামী মানুষের হৃদয়ে। এই আলো কখনো নিভে যাওয়ার নয়। এই আলো আমাদের নয় মাস দেখিয়েছে মুক্তির পথ, সারা জীবন পথ দেখিয়ে যাবে সমৃদ্ধি আর সোনার বাংলা অর্জনের পথে। বঙ্গবন্ধুর দৈহিক মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু যে আদর্শ তিনি প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন, তা সব সময় বাঙালি জাতির কাছে অমলিন। তাই তো তিনি আমাদের কিংবদন্তি, আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের অপর নাম!
কবিতার ভাষায় বললে,
“যতো দূরে যাও পাখি, দেখা হবে ফের,
স্বাধীন ঐ আকাশটা শেখ মুজিবের…”
- মোঃ মুয়াজ্জাজুর রহমান, বিভাগীয় সম্পাদক, সুনামগঞ্জ মিরর