বিলুপ্তপ্রায় জগন্নাথপুরের পাইলগাঁও জমিদার বাড়ি
আধুনিক যুগে এসে কালের সাক্ষী হয়ে আছে এদেশের অসংখ্য পুরোনো জমিদারবাড়ি। আমাদের দেশের ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যের এক অনন্য প্রতীক হলো পুরোনো যুগের জমিদারবাড়িগুলো। অতীতের স্মৃতি বিজড়িত এসব জমিদারবাড়ির সৌন্দর্য মুগ্ধ করে সকল বয়সী ভ্রমণপ্রেমীদের। প্রাচীন স্থাপনার মনোমুগ্ধকর কারুকার্য আর শিল্পিক নির্মাণশৈলী শোভা আকর্ষণ করে স্থাপত্যশিল্পে আগ্রহী অথবা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের পর্যটকদেরকেও। বলা যায় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখার জন্য প্রাচীন জমিদারবাড়িগুলো ভ্রমণপ্রেমী পর্যটকদের অন্যতম প্রিয় গন্তব্য। তেমনই এক কালের নীরব সাক্ষী সুনামগঞ্জের পাইলগাঁও জমিদারবাড়ি। তিনশত বছরের পুরনো এই জমিদারবাড়িটি এই অঞ্চলের গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে।

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার ০৯ নং ইউনিয়নে পাইলগাঁও জমিদারবাড়ি অবস্থিত। তিনশত বছর আগে প্রায় সাড়ে পাঁচ একর জায়গার ওপর তৈরী করা হয় এই সুবিশাল জমিদারবাড়িটি। জমিদারবাড়ির দক্ষিণ দিকে রয়েছে সিলেটের কুশিয়ারা নদী। কুশিয়ারা নদীর তীর থেকে অসাধারণ কারুকাজ আর নকশা সমৃদ্ধ জমিদারবাড়িটিকে দেখতে দারুণ নান্দনিক মনে হয়। অতি পুরোনো এই জমিদারবাড়ির ঘরগুলো যেন নান্দনিক স্থাপত্যশিল্পের সমৃদ্ধ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও বিদ্যমান রয়েছে। একটি ঘরের ছাদ দেয়া হয়েছিলো ইটের টাইলস দিয়ে; যার অনেকগুলোই এখন বিনষ্ট হয়ে গেছে। বড় ঘরের ছাদে রয়েছে বিশাল লোহার পাত যা প্রাচীন পুরাকীর্তির অন্যতম নিদর্শন। পাইলগাঁও জমিদার পরিবারের শেষ জমিদার ছিলেন ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ। তিনি সিলেট বিভাগের কংগ্রেস সভাপতি এবং আসাম আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন।

পাইলগাঁও জমিদার বাড়ির জমিদারদের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এককালে পাইলগাঁও-এ পালবংশীয় লোক বসবাস করত। এ গোষ্ঠীর পদ্মলোচন নামক ব্যক্তির এক কন্যার নাম ছিল রোহিণী। কোন এক কারণে রাঢ় দেশের মঙ্গলকোট হতে গৌতম গোত্রীয় কানাইলাল ধর এখানে আসেন। কানাইলাল ধর এখানে আসার পর রোহিণীকে বিবাহ করে গৃহ-জামাতা হয়ে এখানেই বসবাস শুরু করেন। কানাইলাল ধরের আট পুরুষ পরে বালক দাস নামের এক ব্যক্তির উদ্ভব হয়। সেই বালক দাস হতে এ বংশ বিস্তৃত হয় । বালক দাসের কয়েক পুরুষ পর উমানন্দ ধর ওরফে বিনোদ রায় দিল্লীর বাদশাহ মোহাম্মদ শাহ কর্তৃক চৌধুরী উপাধিপ্রাপ্ত হন। বিনোদ রায়ের দুই পুত্র সন্তান ছিলেন মাধব রাম ও শ্রীরাম। সেই সময়ে মাধব রাম জনকল্যাণে নিজ গ্রাম পাইলগাঁও-এ বিরাট এক দিঘী খনন করেন। এই মহতী কাজের জন্য তিনি প্রচুর সুনাম অর্জন করেন। তাঁর সেই দিঘী আজও ঐ অঞ্চলে “মাধব রামের তালাব” হিসেবে পরিচিত। মাধব রামের দুই পুত্র মদনরাম ও মোহনরাম। মোহনরামের চার পুত্র সন্তান ছিলেন দুর্লভরাম, রামজীবন, হুলাসরাম ও যোগজীবন। এই চার ভাই দশসনা বন্দোবস্তের সময় কিসমত আতোয়াজানের যথাক্রমে ১ থেকে ৪ নং তালুকের বন্দোবস্ত গ্রহণ করে তালুকদার নাম ধারণ করেন। এদের মধ্যে হুলাসরাম বানিয়াচং রাজ্যের দেওয়ানি কার্যালয়ে উচ্চ পদের কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত হন।
হুলাসরাম তালুকদার দেওয়ানি কার্যালয়ে কাজ করার সময় বানিয়াচং রাজ্যের রাজা দেওয়ান উমেদ রাজার সন্তুষ্টি অর্জন করেন। রাজা দেওয়ান উমেদ রাজার অনুগ্রহে আতুয়াজান পরগণায় কিছু ভূমি দান প্রাপ্ত হন। হুলাসরাম তালুকদারের প্রাপ্ত ভূমির কিছু অংশ ছিলো চাষযোগ্য আর কিছু ভূমি ছিলো চাষের অযোগ্য। পরবর্তীতে হুলাসরাম চাষের অযোগ্য ভূমিগুলোকে সঠিক পরিচর্চার মাধ্যমে চাষযোগ্য করে তোলেন। এতে করে তিনি প্রচুর কৃষিজমির মালিক হয়ে যান। এর পর তিনি জমিদারীও লাভ করেন। হুলাসরামের ভ্রাতুষ্পুত্র বিজয়নারায়ণের একমাত্র পুত্র ব্রজনাথ চৌধুরী সে জমিদারি বর্ধিত করে এক প্রভাবশালী জমিদারে পরিণত হন। ব্রজনাথ চৌধুরীর দুই পুত্র রসময় ও সুখময় চৌধুরী ছিলেন। রসময় চৌধুরীর পুত্র ব্রজেন্দ্র নারায়নই ছিলেন এ বংশের শেষ জমিদার। ইতিহাসে সুখময় চৌধুরী ও তাঁর ভাতিজা ব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। পাইলগাও সহ সমগ্র সিলেট বিভাগের শিক্ষা, সাহিত্য, রাজনীতি ও সমাজসেবায় পাইলগাঁও জমিদার বাড়ির জমিদারদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিলো।
কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই প্রভাবশালী খ্যাতনামা পুরুষদের চারণভূমি এই ঐতিহাসিক জমিদারবাড়িটি আজ প্রায় বিলীন অবস্থায় পড়ে আছে। তবে আশার কথা, নতুন প্রজন্মের দর্শনার্থীদের কাছে এটি একটি প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে দিনকেদিন আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। বর্তমানে শীতকালীন ছুটিসহ সবধরনের ছুটির দিনেই এখানে পর্যটকদের ভিড় জমে। স্থানীয় প্রশাসন উদ্যোগ নিলে চমৎকার এক পর্যটনকেন্দ্র হতে পারে শত বছরের পুরনো ঐতিহাসিক এই জমিদারবাড়িটি।

জেনে নেওয়া যাক পাইলগাঁও জমিদার বাড়ি আসার রাস্তা:
পাইলগাঁও জমিদার বাড়ি যেতে হলে আপনাকে প্রথমে সুনামগঞ্জ অথবা সিলেট শহরে আসতে হবে দিনরাত ঢাকা-সিলেট-সুনামগঞ্জ বাস চলাচল করে। সুবিধামতো সময়ে হানিফ, মামুন কিংবা শ্যামলী পরিবহনের বাসে চেপে বসলেই হবে। বাস আপনাকে নিয়ে আসবে সিলেটে অথবা সুনামগঞ্জ সদরে; আর সেখান থেকে পাইলগাঁও জমিদার বাড়ি যেতে হলে আগে যেতে হবে জগন্নাথপুর উপজেলা সদরে। জগন্নাথপুর সদর থেকে সিএনজি, বাইক অথবা অটোরিকশা দিয়ে অল্প সময়েই যেতে পারবেন পাইলগাঁও জমিদার বাড়ির উঠোনে।
- লেখা: আসাদুর রহমান ইজাজ
- সম্পাদনা: মল্লিক ওয়াসি উদ্দিন তামী
সুনামগঞ্জমিরর/ডব্লিউটি