ঘুরে আসুন নয়নাভিরাম শিমুল বাগান
সুনামগঞ্জ জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বরাবরই পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে থাকা এ জনপদে প্রকৃতি এবং মানুষের অপূর্ব এক মিতালী গড়ে উঠেছে। আজকে আপনাদের এমনই একটা সুন্দর জায়গার কথা বলবো। জায়গাটার নাম শিমুল বাগান।

শিমুল বাগানের অবস্থান সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নে। একেবারে সীমান্ত ঘেঁষা এলাকা। শিমুল বাগানে দাঁড়িয়ে আপনি দূরের সারি সারি পাহাড় দেখতে পাবেন, যদিও এসব পাহাড় ভৌগলিকভাবে ভারতে অবস্থিত।

বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন ২০০২ সালে নিজের প্রায় ২ হাজার ৪শ’ শতক জমিতে সৌখিনভাবে এই শিমুল বাগান গড়ে তোলেন। এখানে তিন হাজারের মতো শিমুল গাছ রয়েছে। এর সাথে লেবুর বাগানও গড়ে উঠেছে। ফাল্গুন মাসে শিমুল বাগানের হাজার হাজার গাছে রক্তিম ফুল ফোটে। ড্রোন ক্যামেরা থেকে তোলা ছবিতে মনে হয় যেন লাল রঙের উৎসব চলছে বাগানজুড়ে। দেশি পর্যটকদের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকরাও আসেন শিমুলের টানে। এই নয়নাভিরাম জায়গাটি এখন বিয়ের ফটোশ্যুট, মডেলিং কিংবা শুটিংয়ের জন্য দারুণ জনপ্রিয়। ফাল্গুন মাস ছাড়াও, বছরের অন্যান্য মাসেও পর্যটকদের আনাগোনা দেখা যায় এখানে। স্থানীয় মানুষ, পর্যটক, ক্যামেরাম্যান, ছোট ছোট পানি বিক্রেতা বাচ্চা চোখে পড়বে আপনার। ইচ্ছা করলে ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছবি তুলতে পারবেন। প্রতি ছবি তিন টাকা নেবে।

শিমুল বাগানে বিছানো সবুজ কার্পেটের ঢেকে আছে সবুজ ঘাসের স্তর। এই ঘাস গবাদিপশুর খাদ্যের যোগান দেয়। বাগানে রাখাল ছেলেরা গরু চড়ায়, গলা ছেড়ে গান গায়। শিমুল বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে টলটলে পানির যাদুকাটা নদী। যাদুকাটা নদী এক সময় প্রবল খরস্রোতা ছিলো। ভারত থেকে নেমে আসা পাথর, কয়লা এবং বড় বড় মাছের এক অফুরন্ত আধার ছিলো। কালের বিবর্তনে যাদুকাটা নদী এখন অনেকটাই ছোট হয়ে গেছে। বালি জমে চর পড়ে গেছে। তবুও যাদুকাটা নদীর পানি ভীষণ স্বচ্ছ। ডুব দিয়ে ছবি তুলতে পারবেন, কুড়াতে পারবেন নানারকম সুন্দর পাথর।

যাদুকাটা নদী নিয়ে প্রচলিত আছে অনেক কেচ্ছা-কাহিনী। এই নদীতে নাকি একসময় অনেক বড় বড় মাছ পাওয়া যেত। একদিন এক মহিলা নদীর ধারে মাছ কাটতে বসেছেন, পাশে ছিলো উনার ছোট বাচ্চা। অন্ধকারে ঢুলুঢুলু হয়ে মাছের বদলে নিজের বাচ্চাকেই কেটে ফেলেন তিনি। এর থেকেই নাকি এই নদীর নাম হয় ‘যাদুকাটা’। আর তখন থেকে নদীকে নিয়ে অনেক ভয়, অজানা আশংকা এখনো মানুষের মাঝে কাজ করে। শিমুল বাগানে ঘুরতে আসলে স্থানীয় লোকজনের মুখে এইসব গল্প শুনতে পারেন।

যাদুকাটা নদীর কথা এত করে বললাম কারণ, এটি শিমুল বাগানের জীবনীশক্তির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। নদীর পানি বাগানকে উর্বর করে, তীরের মানুষকে দেয় জীবিকার অবলম্বন। তাই শিমুল বাগান দেখতে আসলে অবশ্যই যাদুকাটা নদীকে স্পর্শ করতে ভুলবেন না। তবে, শীতের সময় নদী অনেকটাই শুকিয়ে যায়। সেসময় এলে কেবল বালির ধু ধু চর চোখে পড়বে।

যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জে সরাসরি বাস সার্ভিস আছে। শ্যামলী, বিআরটিসি, মামুন, হানিফ পরিবহনসহ অনেক বাস পাবেন আসার জন্য। ভাড়া নেবে ৫৫০ টাকা। সুনামগঞ্জ শহরে এসে নাস্তা করে রওনা দিতে পারেন বাদাঘাটের উদ্দেশ্যে। শহর থেকে মোটরসাইকেলে জনপ্রতি ভাড়া একশ টাকা নেবে। সিএনজিতেও যেতে পারেন। ৫০০টাকায় রিজার্ভ করে নিয়ে গেলে চার-পাঁচজন অনায়াসেই যেতে পারবেন। সময় লাগবে দেড় ঘন্টার মতো। মোটরসাইকেল আপনাকে বাদাঘাট বাজারে নামিয়ে দেবে। সেখান থেকে অটোরিকশা অথবা মোটরসাইকেলে উঠে সরাসরি চলে যেতে পারবেন শিমুল বাগানে। ভাড়া নেবে ৪০-৫০ টাকা জনপ্রতি। শিমুল বাগানে ঢোকার জন্য টিকেট লাগবে। জনপ্রতি টিকেটের মূল্য ১০ টাকা। যদি সারাদিন সেখানে কাটাতে চান, তাহলে অবশ্যই সাথে করে খাবার নিয়ে যাবেন, নদীতে গোসলের জন্য বাড়তি কাপড় নিয়ে যেতে হবে।
সাবধানতা: যেহেতু সুনামগঞ্জ বন্যাপ্রবণ এলাকা, তাই রাস্তাঘাটের অবস্থা একটু খারাপ। যানবাহনে সতর্ক হয়ে বসতে হবে। নদীতে পানি কম থাকলেও চোরাবালি থাকতে পারে। তাই বেশি দূরে যাবেন না। যেহেতু সীমান্ত ঘেঁষা এলাকা, তাই সাবধান থাকতে হবে যাতে সীমান্ত অতিক্রম না হয়ে যায়। খাবারের প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতল ফেলে পরিবেশ নষ্ট করবেন না।
প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য দেখতে হলে শিমুল বাগানের জুড়ি নেই। তাই সময় পেলে চলে আসুন। অংশ হয়ে যান রক্তিম এক ভালোবাসার।
- মুয়াজ্জাজুর রহমান মুয়াজ, বিভাগীয় সম্পাদক, সুনামগঞ্জ মিরর
[প্রিয় পাঠক, সুনামগঞ্জ মিরর সুনামগঞ্জের পর্যটন খাত নিয়ে কাজ করতে চায়। জেলার আনাচে কানাচের দৃষ্টিনন্দন স্থানগুলোর গল্প এক এক করে তুলে আনবে সুনামগঞ্জ মিরর। এ যাত্রায় সঙ্গে থাকবেন। এছাড়া, পর্যটন বিষয়ক যেকোনো তথ্যের জন্যও সুনামগঞ্জ মিররের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন; সঙ্গে আপনাদের মূল্যবান পরামর্শ ও মতামত জানাতে ভুলবেন না।]