বিশ্ব ক্রিকেটের তিন ‘জমিদার’
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) সম্পর্কে অনেক কৌতুক চালু আছে। কেউ বলেন ক্রিকেটের বিশ্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি পাড়ার সমাজকল্যাণ সংঘের মতো, সাইনবোর্ডের ভারী নামের আড়ালে যাদের কাজের কাজ কিছুই নেই। কারও কাছে এটা ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার। যেটি আসলে বড় ক্রিকেট বোর্ডগুলোর হাতের পুতুল।
কৌতুক কিংবা অভিযোগ যা-ই বলুন, সবই যে সত্যি তাতে আর সন্দেহ থাকছে না। খোদ আইসিসি সেটা স্বীকার করে নিতে যাচ্ছে এ মাসের শেষে দুবাইয়ে অনুষ্ঠেয় বোর্ড সভায়।
নিজেদের ‘নিধিরাম সর্দার’ বানিয়ে একেবারে ঘোষণা দিয়ে সব ক্ষমতা তুলে দিচ্ছে এত দিন আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়া ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই), ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ) এবং ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) হাতে। বিশ্ব ক্রিকেট শাসন করতে আড়াল থেকে এবার ঘোষণা দিয়ে সামনে আসছে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী তিন ক্রিকেট বোর্ড!
মূলত এই তিন বোর্ডের সদস্যদের নিয়ে গড়া আইসিসির অর্থ ও বাণিজ্যসংক্রান্ত কমিটি (এফঅ্যান্ডসিএ) শুধু ক্রিকেট প্রশাসন নয়, আইসিসির পুনর্গঠনেও একটা খসড়া প্রস্তাব দিয়েছে আইসিসিকে।
৯ জানুয়ারি আইসিসির পরিচালকদের সভায় সেটাই নাকি তুলে দেওয়া হয়েছে আইসিসির সদস্যদেশগুলোর হাতে। প্রস্তাব বিবেচনার জন্য তা ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি দুবাইয়ে হতে যাওয়া আইসিসির কার্যনির্বাহী বোর্ডের সভায় তোলা হবে।
কী আছে সেই প্রস্তাবে? প্রথমত বাকি সবার সব ক্ষমতা খর্ব করে বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রণ প্রস্তাবিত চার সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটির (এক্সকো) হাতে তুলে দেওয়া। এক্সকোর তিন স্থায়ী সদস্য হিসেবে থাকবেন বিসিসিআই, সিএ আর ইসিবির তিন প্রধান।
বাকি সাত দেশের মনোনীত প্রতিনিধি হবেন চতুর্থ সদস্য। তবে এই মনোনয়ন দেবে আইসিসির কার্যনির্বাহী বোর্ড। খসড়া প্রস্তাব অনুযায়ী এক্সকোই হবে আইসিসির হর্তাকর্তা। কিছুদিন আগে তৈরি হওয়া আইসিসি চেয়ারম্যানের পদটাও থাকছে, তবে প্রতিবছর সেই পদে বসবেন ওই তিন ক্রিকেট বোর্ডের মনোনীত যেকোনো প্রতিনিধি।
তার মানে আক্ষরিক অর্থেই ক্রিকেট ফিরে যাচ্ছে শুরুর দিনগুলোতে যখন ‘সুপার পাওয়ার’ অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড বোর্ড ছড়ি ঘোরাত বাকি সবার ওপরে। পার্থক্য শুধু, দুই বোর্ডের সঙ্গে ছড়িটা ঘোরাবে এখন আরেক পরাশক্তি ভারতও।
নিয়ন্ত্রণটা শুধু প্রশাসনে নয়, আসছে মাঠের খেলাতেও। দ্বিস্তরবিশিষ্ট টেস্ট ক্রিকেট চালুর কথা অনেক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল, খসড়া প্রস্তাবে সেটাও আছে। টেস্ট খেলতে পারবে আফগানিস্তান, আয়ারল্যান্ডের মতো সহযোগী দেশগুলোও। প্রস্তাব অনুযায়ী পারফরম্যান্স অনুযায়ী দলগুলোর প্রথম বিভাগ ও দ্বিতীয় বিভাগে উন্নতি বা অবনমন হবে।
তবে পারফরম্যান্স যা-ই হোক, ভারত, অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের অবনমন হবে না! যুক্তি দেওয়া হয়েছে, যেহেতু আইসিসির সিংহভাগ আয়ের উৎস এই তিন দেশের বাজার, সেহেতু তাদের সুরক্ষা দিতে হবে।
উঠে যাচ্ছে আইসিসির ফিউচার ট্যুর প্রোগ্রাম বা এফটিপিও। প্রস্তাব অনুযায়ী এখন থেকে আইসিসি কোনো দেশকে অন্য দেশের সঙ্গে সিরিজ খেলতে বাধ্য করতে পারবে না। সব সূচি নির্ধারিত হবে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতায়। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ বাতিল হলেও আবারও চালু হবে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। ২০১৭ সালে এটির পরের আসর বসতে পারে ইংল্যান্ডে।
যে কারণে এত পরিবর্তন সেটা অবশ্য পরিষ্কার আইসিসির উপার্জিত অর্থ বণ্টনের প্রস্তাবনায়। এখনকার নিয়মানুযায়ী আইসিসির উদ্বৃত্ত লাভের ৭৫ শতাংশ দেওয়া হতো পূর্ণ সদস্যদেশগুলোকে, বাকি ২৫ শতাংশ পেত সহযোগী ও অনুমোদিত দেশগুলো।
এফঅ্যান্ডসিএ জানিয়েছে, এই নিয়মটা আইসিসির আয়ে বড় ভূমিকা রাখা দেশকে স্বীকৃতি দেয় না। কমিটির তথ্যানুযায়ী আইসিসির এখনকার আয়ের ৮০ শতাংশই ভারতের অবদান। যদিও এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ দেখানো যায়নি। আয় ও বণ্টনের কাঠামো পুনর্গঠনের জন্য তাই আইসিসি বিজনেস কমিটি (আইবিসি) গঠনের প্রস্তাব করেছে কমিটি।
যেটির কাজ হবে আইসিসির আয়ে অবদান রাখা বোর্ডগুলোকে যথাযথ লভ্যাংশ বণ্টনসহ সব রকম আর্থিক বিষয় নিয়ন্ত্রণ করা। ধারণা করা হচ্ছে, নতুন এই বণ্টনকাঠামো কার্যকর হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড।
সে কারণেই কি না অন্য প্রস্তাবগুলো গ্রহণের ব্যাপারে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া না হলেও আইবিসি গঠনের জন্য আগামী এপ্রিল পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছেন প্রস্তাবকেরা। যাতে ২০১৫ থেকে ২০২৩ সময়কালের আইসিসির মিডিয়া ও স্পনসরশিপ স্বত্ব চুক্তির আগেই কাজ শুরু করতে পারে আইবিসি।
ক্রিকেট নয়, বাণিজ্যই যে পুরো প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্য সেটা কি এর পরও খোলাসা করে বলতে হবে? (প্রথম আলো)