মেসির ‘৪০০’
২০০৪ সাল। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে পা রেখেছিলেন লিওনেল মেসি। তারপর টানা নয়টি বছর ধরে পুরো ফুটবল বিশ্বকেই মাতিয়ে রেখেছেন এই আর্জেন্টাইন তারকা। ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত টানা চারবার জিতেছেন ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার। একের পর এক রেকর্ড আর মাইলফলক পাড়ি দিয়ে গতকাল আরও একটি নতুন মাইলফলক স্পর্শ করেছেন এসময়ের অন্যতম সেরা ফুটবলার। মাত্র ২৬ বছর বয়সেই স্পর্শ করেছেন বার্সেলোনার হয়ে ৪০০ ম্যাচ খেলার মাইলফলক। সামনে যে আরও অনেক পথই পাড়ি দেবেন, সে ব্যাপারেও সংশয়ের অবকাশ নেই। কতদূর পর্যন্ত যাবেন—সেটা সময়ই বলে দেবে। আপাতত আমরা দেখে নিতে পারি কীভাবে মেসি এলেন এই ৪০০তম ম্যাচ পর্যন্ত।
সংখ্যাতত্ত্বে মেসির ৪০০ ম্যাচের মাইলফলক
১. ২০০৪ সালের অক্টোবরে বার্সেলোনার মূল দলের হয়ে অভিষেক হয়েছিল মেসির। ডেকোর বদলি হিসেবে শেষ সাত মিনিটের জন্য মাঠে নেমেছিলেন এসপানিওলের বিপক্ষে। সে সময় তাঁর বয়স ছিল ১৭ বছর ১১৪ দিন। সেই সময়ে সেটাই ছিল লা লিগায় বার্সেলোনার পক্ষে সবচেয়ে কম বয়সে অভিষেকের নতুন রেকর্ড। পরবর্তী সময়ে অবশ্য এই রেকর্ডটা ভেঙে দিয়েছেন বোজার কিরকিচ।
৫. বার্সেলোনার জার্সি গায়ে নিজের পঞ্চম ম্যাচে মেসির অভিষেক হয়েছিল চ্যাম্পিয়নস লিগে। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে শাখতার দানেস্কের বিপক্ষে সেই ম্যাচটা বার্সেলোনা হেরেছিল ২-০ গোলে।
৯. বার্সেলোনার পক্ষে প্রথম গোলটি মেসি করেছিলেন নিজের নবম ম্যাচে। বদলি হিসেবে মাঠে নেমে রোনালদিনহোর সহায়তায় বল জড়িয়েছিলেন আলবাসেতের জালে।
১৬. চ্যাম্পিয়নস লিগে প্রথম গোলটি মেসি করেছিলেন নিজের ১৬তম ম্যাচে। ফরাসি একটি ক্লাবের বিপক্ষে সেই ম্যাচটা বার্সেলোনা জিতেছিল ৫-০ গোলে।
১৮. ক্যারিয়ারের প্রথম ‘এল ক্লাসিকো’টাই জয় দিয়ে স্মরণীয় করে রেখেছিলেন মেসি। রোনালদিনহোর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে সেই ম্যাচটা কাতালানরা জিতেছিল ৩-০ গোলে।
৩২. কয়েকদিন আগে নেইমার বলেছিলেন, ‘আমি নাটক করি না।’ বার্সেলোনায় ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে এমন কথা মেসিকেও বলতে হয়েছিল। চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচে মেসিকে ফাউল করে লাল কার্ড দেখেছিলেন চেলসির ডিফেন্ডার। ম্যাচটাও চেলসি হেরেছিল ২-১ গোলে। ম্যাচশেষে মেসির বিরুদ্ধে নাটক করার অভিযোগ এনেছিলেন চেলসি কোচ হোসে মরিনহো। জবাবে মেসিও বলেছিলেন, ‘আমি নাটক করি না।’ এটা ছিল বার্সেলোনার জার্সি গায়ে মেসির ৩২তম ম্যাচ।
৩৪. প্রথমবারের মতো বড় ধরনের ইনজুরির কবলে পড়েছিলেন নিজের ৩৪তম ম্যাচে। সেই মৌসুমে বার্সেলোনা স্প্যানিশ লিগ, চ্যাম্পিয়নস লিগ—দুটোই জিতেছিল। কিন্তু মেসিকে মৌসুমের বাকি সময় মাঠের বাইরেই কাটাতে হয়েছিল।
৫৭. ন্যু ক্যাম্পে নিজের প্রথম এল ক্লাসিকোটাও মেসি স্মরণীয় করে রেখেছিলেন দুর্দান্ত এক হ্যাটট্রিক করে। প্রতিবার পিছিয়ে গিয়েও মেসির দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে শেষ পর্যন্ত ৩-৩ গোলের ড্র নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল কাতালানরা।
৬২. অনেক দিন আগে থেকেই মেসিকে বলা হতো নতুন ম্যারাডোনা। এই তকমার যথার্থতাটা মেসি প্রমাণ করেছিলেন বার্সেলোনার হয়ে নিজের ৬২তম ম্যাচে। গেটাফের ছয়জন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে যে গোলটা করেছিলেন, সেটার সঙ্গে অনেক মিলই পাওয়া যায় ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ম্যরাডোনার সেই বিস্ময়কর গোলটির।
৬৯. এই ম্যাচে ম্যারাডোনার মতো হাত দিয়েও একটি গোল করেছিলেন মেসি। এসপানিওলের বিপক্ষে সেই ম্যাচটা বার্সেলোনা ড্র করেছিল ২-২ গোলে।
১০০. বার্সেলোনার হয়ে শততম ম্যাচটা স্মরণীয় করে রাখতে তো পারেনইনি, বরং খানিকটা হতাশাই মিশে ছিল। কোপা ডেল রের সেমিফাইনালে ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র করে মাঠ ছেড়েছিল কাতালানরা। সেবারের মৌসুমটাও মেসি শেষ করেছিলেন কোনো শিরোপা ছাড়াই।
১১১. পেপ গার্দিওলার তত্ত্বাবধানে প্রথম ম্যাচটি মেসি খেলেছিলেন বার্সেলোনা ক্যারিয়ারের ১১১তম ম্যাচে। বিস্ময়করভাবে সেই ম্যাচটা তারা হেরেও গিয়েছিল নবাগত দল নুমানসিয়ার বিপক্ষে।
১৫৭. বার্নাব্যুতে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে মেসিকে মাঝখানে আক্রমণভাগ সাজিয়েছিলেন গার্দিওলা। রণকৌশলের যথার্থতা প্রমাণ করে জোড়া গোল করেছিলেন মেসি। ম্যাচটাও বার্সা জিতেছিল ৬-২ গোলের বড় ব্যবধানে।
১৬০. অ্যাথলেটিক বিলবাওকে ৪-১ গোলে হারিয়ে বার্সেলোনা জিতেছিল কোপা ডেল রের শিরোপা। এটাই ছিল গার্দিওলার অধীনে বার্সার প্রথম শিরোপা। কয়েক দিন পরে লা লিগার শিরোপাটাও উঠেছিল কাতালানদের হাতে।
১৬১. প্রথমবারের মতো ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মুখোমুখি হয়েছিলেন মেসি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে সেই ম্যাচে গোলও করেছিলেন আর্জেন্টাইন তারকা। বার্সেলোনা জিতেছিল চ্যাম্পিয়নস লিগ।
১৬২. পরের ম্যাচেই অ্যাথলেটিক বিলবাওকে ৩-০ গোলে হারিয়ে স্প্যানিশ সুপারকাপও জিতেছিল বার্সেলোনা। মেসি এই ম্যাচে করেছিলেন জোড়া গোল।
১৮৪. এক মৌসুমে ছয়টি শিরোপা জয়ের চক্র মেসি পূর্ণ করেছিলেন নিজের ১৮৪তম ম্যাচে। অতিরিক্ত সময়ে মেসির গোলেই আর্জেন্টাইন ক্লাব এস্তুদিয়ানতেসকে হারিয়ে ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছিল বার্সেলোনা।
১৯৯. বার্সেলোনার পক্ষে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে লা লিগার টানা দুটি ম্যাচে হ্যাটট্রিক করার কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন মেসি। ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করার পরের সপ্তাহেই জারাগোজার জালেও তিনবার বল জড়িয়েছিলেন।
২০০. শততম ম্যাচটা না পারলেও ক্যারিয়ারের ২০০তম ম্যাচটা জয় দিয়েই উদযাপন করেছিলেন মেসি। ওসাসুনার বিপক্ষে সেই ম্যাচটা কাতালানরা জিতেছিল ২-০ গোলে।
২০৪. ন্যু ক্যাম্পে আর্সেনালের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালে চারটি গোল করেছিলেন মেসি। এই ম্যাচটার পরেই গানারদের কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গার মেসির খেলাকে ‘প্লেস্টেশন’-এর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
২০৫. রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ২-০ গোলে জয় দিয়ে লা লিগার শিরোপা জয় নিশ্চিত করেছিল বার্সেলোনা।
২১০. কিন্তু কয়েক ম্যাচ পরেই চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে ইন্টার মিলানের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয়েছিল বার্সেলোনাকে।
২১৬. পাঁচ ম্যাচ পরেই অবশ্য আরেকটি হ্যাটট্রিক করে দলের স্প্যানিশ সুপারকাপের জয় নিশ্চিত করেছিলেন মেসি। সেভিয়ার বিপক্ষে সেই ম্যাচটা বার্সা জিতেছিল ৪-০ গোলে।
২৩১. নিজের ২৩১তম ম্যাচে আরও একটি হ্যাটট্রিক করেছিলেন মেসি। আলমেইরার বিপক্ষে সেই ম্যাচটা বার্সা জিতেছিল ৮-০ গোলের বিশাল ব্যাবধানে।
২৩৩. পর্তুগিজ কোচ হোসে মরিনহোর অধীনে প্রথমবারের মতো এল ক্লাসিকো খেলতে নেমে নাস্তানাবুদ হয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। মেসির বাড়িয়ে দেওয়া বল থেকে দুটি গোল করেছিলেন ডেভিড ভিয়া। ২০১০ সালের নভেম্বরে সেই ম্যাচটা বার্সেলোনা জিতেছিল ৫-০ গোলে।
২৫০. ন্যু ক্যাম্পে অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের বিপক্ষে উত্তেজনাপূর্ণ একটি ম্যাচ বার্সেলোনা ২-১ ব্যবধানে জিতেছিল মেসির শেষ মুহূর্তের গোলে।
২৬১. মরিনহোর বিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে প্রথম গোলটি করেছিলেন মেসি। সেই ম্যাচে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোও করেছিলেন বার্সেলোনার বিপক্ষে নিজের প্রথম গোল। ম্যাচটাও শেষ হয়েছিল ১-১ গোলের ড্র দিয়ে।
২৬২. কোপা ডেল রের ফাইনালে বার্সেলোনাকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল রিয়াল মাদ্রিদ। গোল করার উল্লাসে মেতেছিলেন রোনালদো। আর সাজঘরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন মেসি।
২৬৪. দুই ম্যাচ পরেই অবশ্য প্রতিশোধটা ভালোমতোই নিয়েছিলেন মেসি। রিয়ালের বিপক্ষে জোড়া গোল করে দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে।
২৬৯. ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে দারুণ এক গোল করে শিরোপা জয়ের স্বাদ পেয়েছিলেন মেসি।
২৭১. ন্যু ক্যাম্পে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে জোড়া গোল করে দলকে ৩-২ গোলের জয় এনে দিয়েছিলেন মেসি। এর আগে প্রথম লেগটা শেষ হয়েছিল ২-২ গোলের ড্র নিয়ে। এ ম্যাচেই বার্সার তত্কালীন সহকারী কোচ টিটো ভিলানোভার চোখে গুঁতো দিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন মরিনহো।
২৭২. এক ম্যাচ পরেই, আবারও মেসির গোলে বার্সেলোনার আরেকটি শিরোপা জয়। এবার ২-০ গোলে পোর্তোকে হারিয়ে উয়েফা সুপার কাপ জিতেছিল কাতালানরা।
২৮১. বার্সেলোনার জার্সি গায়ে নিজের ২৮১তম ম্যাচে জোড়া গোল করে হাঙ্গেরিয়ান কিংবদন্তি কুবালাকে পেছনে ফেলেছিলেন মেসি। এই ম্যাচের পরপরই আদ্রিয়ানো বলেছিলেন, ‘ন্যু ক্যাম্পের বাইরে কুবালার মতো মেসিরও একটা মূর্তি থাকা দরকার।’
২৯৫. বর্তমান সতীর্থ নেইমারের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো মাঠে নেমেছিলেন মেসি। ক্লাব বিশ্বকাপের ফাইনালে নেইমারের সান্তোসকে ৪-০ গোলে হারিয়ে আরও একবার শিরোপা জিতেছিল বার্সেলোনা।
৩০০. কাকতালভাবে মেসির ৩০০তম ম্যাচের মাইলফলক স্পর্শের দিনটা ছিল তত্কালীন কোচ গার্দিওলার জন্মদিন। দুটো উপলক্ষই দারুণভাবে উদযাপন করেছিলেন মেসি ও গার্দিওলা। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদকে তাদের মাঠেই ২-১ গোলে হারিয়েছিল বার্সেলোনা।
৩০৯. আবারও চার গোল করে ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে বার্সেলোনাকে ৫-১ গোলের জয় এনে দিয়েছিলেন মেসি।
৩১১. এবার এক ম্যাচেই মেসি করেছিলেন পাঁচটি গোল। চ্যাম্পিয়নস লিগের দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলায় বায়ার লেভারকুসেনের বিপক্ষে বার্সা পেয়েছিল ৭-১ গোলের জয়।
৩১৪. গ্রানাডার বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে বসে গিয়েছিলেন বার্সেলোনার সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতার আসনে। পেছনে ফেলেছিলেন সিজার রদ্রিগেজকে (২৩২ গোল)।
৩২৭. ন্যু ক্যাম্পে গার্দিওলার বিদায়ী ম্যাচে নগর প্রতিদ্বন্দ্বী এসপানিওলের বিপক্ষে চারটি গোল করেছিলেন মেসি। বার্সাও ম্যাচটা জিতেছিল ৪-০ ব্যবধানে।
৩২৯. অ্যাথলেটিক বিলবাওকে ৩-০ গোলে হারিয়ে কোপা ডেল রে শিরোপা জিতেছিল বার্সেলোনা। এটাই ছিল বার্সেলোনার কোচ হিসেবে গার্দিওলার শেষ ম্যাচ। এই মৌসুমটাও মেসি শেষ করেছিলেন রেকর্ড ৭৩টি গোল করে।
৩৫২. ২০১২ সালের ডিসেম্বরে রিয়াল বেটিসের বিপক্ষে জোড়া গোল করে এক বছরে পেছনে ফেলেছিলেন জার্মান কিংবদন্তি জার্ড মুলারকে। এক বছরে সর্বোচ্চ ৯১টি গোল করার রেকর্ডটা এখনো আছে মেসির দখলে। ১৯৭২ সালে জার্মানি ও বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে মুলার করেছিলেন ৮৫টি গোল।
৩৭৩. সেলটা ভিগোর বিপক্ষে গোল করে মেসি গড়েছেন স্প্যানিশ লিগের সব কয়টি দলের বিপক্ষে গোল করার নতুন রেকর্ড।
৪০০. ৪০০তম ম্যাচটাও দারুণভাবে উদযাপন করেছেন মেসি। নিজে গোল না পেলেও তাঁর সহায়তা থেকেই হ্যাটট্রিক করেছেন তরুণ স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড ক্রিশ্চিয়ান তেল্লো। বার্সাও ম্যাচটা জিতেছে ৪-১ গোলে।