জামায়াত ও শিবিরের মতপার্থক্য বাড়ছে!

জামায়াতের করুণ পরিণতির জন্য বর্তমান দুর্বল নেতৃত্বকে দায়ী করেছে ছাত্রশিবির। সংগঠনটির নেতাকর্মীদের অভিযোগ, বাস্তবসম্মত ও যুগপোযোগী সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কারণেই দলটির এই অবস্থা। এ নিয়ে জামায়াত ও এর সহযোগী সংগঠন ছাত্রশিবিরের মতপার্থক্য বাড়ছে।

শিবিরের অনেক নেতাকর্মী মূল দলটির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ। প্রকাশ্যে এসব সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা না বললেও ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

শিবিরের কয়েকজন নেতা এই প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করে বলেন, মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্ব ক্ষমতার রাজনীতিতে অন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

তারা মনে করেন, এখনই যদি বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা নেওয়া না হয় তবে আগামীতে আরো কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে।

জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্বের দুর্বলতাকে দায়ী করে শিবিরের নেতা পর্যায়ের কয়েকজন ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দিয়েছেন।

গত সোমবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গণসমাবেশে জামায়াতকে আসার সুযোগ না দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শামীম (ছদ্মনাম) নামে এক শিবিরনেতা ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘সোহরাওয়ার্দীর গণসমাবেশ থেকে জামায়াতকে ল্যাং মেরে বের করে দিল বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। ন্যক্কারজনক এই ঘটনার পর দায়িত্বশীল ভাইয়েরা অত্যন্ত যুক্তি দিয়ে এর যৌক্তিকতা প্রমাণ করে বলবেন, জোট এবং সংগঠনের বৃহৎ স্বার্থে এটি ভালোই হয়েছে। সবাই মেনে নিন।

হ্যাঁ, ইসলামী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে পরবর্তীতে লজ্জাশরমকে তালাক দিয়ে বিএনপির সমাবেশে আবারও যাব। আর যদি তৃণমূলের একজন কর্মী হিসেবে নির্ভয়ে দায়িত্বশীলদের সামনে কথা বলতে পারতাম, তাহলে গলা চড়িয়ে বলতাম… রাখেন, আপনার যুক্তির ফুলঝুড়ি। বিএনপির গুষ্টি কিলাই। বিএনপির সঙ্গে কোনো মিটিংয়ে আর আমরা নেই।’

‘ভোরের পাখি’ নামে আরেক শিবিরকর্মী তার ফেসবুকে লেখেন, ‘এটা দরকার ছিল অনেক আগেই। ভোগবাদী রাজনীতির সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের জোট হয় না। আমাদের আজ আত্মসমালোচনা করে নিজেদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের শুধুমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করতে হবে। শুধুমাত্র আল্লাহর ওপর।’

এভাবেই অনেক শিবিরকর্মী বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বর্তমান নেতৃত্বের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

সোমবারের গণসমাবেশে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির এমন আচরণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের এক শিবিরনেতা বলেন, আজকের পরিস্থিতির জন্য জামায়াত এককভাবে দায়ী। দলের সংস্কার ও দেশের প্রচলিত বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে ইসলামী আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণ করতে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। দলের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে শুধু পদ পদবির লোভ-লালসা চলে এসেছে।

তাদের অভিযোগ, সংস্কার ও কর্মপদ্ধতি নিয়ে যারাই কথা বলেছেন সে জামায়াতের হোক কিংবা শিবিরের হোক তাকে দলে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। কখনো বা তাকে দল বা সংগঠন থেকে বহিষ্কার কিংবা বাধ্যতামূলক ছুটিতেও পাঠানো হয়েছে।

শিবির সূত্রে জানা গেছে, এই সংস্কারের কথা বলতে গিয়ে ২০১০ সালে শিবিরে বড় ধরনের একটি বিদ্রোহ হয়। সেই সময়ের সেক্রেটারি ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ কার্যকরি পরিষদের ২৪ জন সদস্য পদত্যাগ করেন।

সূত্রের দাবি, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর থেকে যুদ্ধ‍াপরাধীদের বিচারের দাবি ত্বরান্বিত হতে থাকে। এই বিচার ও স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় জামায়াতের ভূমিকার জন্য এখন কী করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে একটি ফায়সালা আসার পরামর্শ দেন তখনকার শিবির সেক্রেটারি শিশির মোহাম্মদ মনির।

৪২ বছর আগের জামায়াতের দায়ভার নতুন প্রজন্মের শিবির নেবে কেন, এ প্রসঙ্গটি সামনে চলে আসে। তার ওই বক্তব্যকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করে ‍ মনিরকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করার নির্দেশ দেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ।

বিষয়টি নিয়ে জামায়াত-শিবিরের মধ্যে বেশ দড়ি টানাটানি হলেও ভাঙ্গন রক্ষা করা যায় নি। কথিত আছে, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, কামারুজ্জামান, কাদের মোল্লা, মীর কাসেম আলীসহ অনেকেই শিবিরের ওই পক্ষের কথা বলেন। শিবিরের সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিয়েও পরে সেখান থেকে সরে আসেন নিজামী। এমন প্রচারণাও রয়েছে দলটির মধ্যে।

শিবিরনেতাদের অভিযোগ, পরিস্থিতির তাৎপর্য সম্পর্কে মনগড়া পর্যালোচনা করে জামায়াতের নেতারা দলটির তৃণমূল নেতাকর্মী ও ছাত্রশিবিরকে একটি ভুল লড়াইয়ে ঠেলে দেন। যে লড়াইয়ে নিশ্চিত মৃত্যু, কারাবরণ, নির্যাতিত হওয়া, পঙ্গুত্ব বরণ করা ও পালিয়ে বেড়ানোর মতো পরিণতি অবশ্যম্ভাবী ছিল।

২০১০ সালে পর দলের স্বার্থে অনেকই নীরব থাকলেও বর্তমান পরিস্থতিতে এই দ্বন্দ্ব দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। ২০১০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শিবিরের তখনকার সেক্রেটারিসহ কার্যকরি পরিষদের ২৪ সদস্য একযোগে পদত্যাগ করার পর থেকেই জামায়াত ও শিবিরের ভেতর-বাইরে সংগঠনের সংস্কারের জোর দাবি উঠে। এই দাবির সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে থাকে দল। অনেককে রাখা হয় কোণঠাসা করে। অনেককে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়।

২০১০ সালের পর থেকে শিবিরের ওপর জামায়াত আরো স্বেচ্ছাচারি হতে থাকে। জামায়াত নেতাদের আশঙ্কা ছিল, শিবির যদি আমাদের পাশে না থাকে তবে আমরা মাঠে মারা যাব।

অন্যদিকে, নতুন প্রজন্মের শিবির বলতে চেয়েছিল, ৪২ বছর আগে স্বাধীনতাযুদ্ধকালে জামায়াতের ভূমিকা ও কার দায়ভার এখন কেন শিবির নেবে। এর দায়ভার কেবল জামায়াত কিংবা তখনকার নেতারাই নেবেন।

সেই সময় পদত্যাগকারী এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদককে বলেন, অনেকদিন আগে থেকেই যুদ্ধাপরাধ ইস্যু নিয়ে শিবিরের মধ্য অস্থিরতা চলে আসছিল। আর এই জেনারেশন একাত্তরের দায় নেবে কেন? শিবিরের মধ্যে একটা পরিবর্তন দরকার ছিল। এখন হয়তো বা সেটা আরো জরুরি হয়ে পড়েছে। জামায়াতের প্রভাবমুক্ত সংগঠন খুবই জরুরি। শিবিরের কত পারসেন্ট ছেলে জামায়াত করে? মনে হয় ১০ ভাগও করে না।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমার বন্ধুরা অনেকেই শিবির করতো। তাদের ২/১ জন ছাড়া আর কাউকে জামায়াতের রাজনীতিতে তো দেখি না।

এ বিষয়টি শিবিরের বর্তমান কার্যকরি পরিষদের একজন সদস্যের দৃষ্টি আকষর্ণ করলে তিনি উল্টো তাদের দিকে তীর মারেন।

তার দাবি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ফারুক হত্যার পর সরকারের নির্যাতনের ভয়ে অনেকেই এই কঠিন সময়ে দায়িত্ব নিতে চাচ্ছিলেন না। এর সঙ্গে নেতৃত্বের মধ্যে কিছু ভুল বুঝাবুঝি তো ছিলোই।

এতো বড় একটা সংগঠনে সামান্য ভুল বুঝাবুঝিকে পাত্তা দিতে চান নি তিনি।

তার দাবি, এই সময় পদত্যাগ করেছে ২০ জন। তাদের মধ্যে ১৩ জনের ছাত্রজীবন শেষ হয়ে গিয়েছিল।

শিবিরকর্মীদের দাবি, সবাইকে মনে রাখতে হবে ইসলামী আন্দোলন এক জিনিস আর ইসলামী পার্টি, রাজনীতি আরেক জিনিস। ইসলামী পার্টির রাজনীতি ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য জুলুম ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনে না। (বাংলানিউজ২৪)

x