আন্দোলনের ‘ব্যর্থতা’ নিয়ে বিএনপিতে দ্বিধাদ্বন্দ্ব
আত্মগোপনে থাকা বিএনপির এক যুগ্ম মহাসচিব সম্প্রতি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ফোন দেয়ার পর তাকে ভৎর্সনা শুনতে হয়। ঢাকা মহানগরীর আন্দোলনের মাঠে সক্রিয় না থাকায় দলীয় প্রধান তার ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এর কয়েকদিন আগে বিএনপির এক স্থায়ী কমিটির সদস্য খালেদা জিয়াকে ফোন দিলে তাকে একই ভাষায় ‘শায়েস্তা’ করেন তিনি। সারাদেশে ‘আন্দোলন’ চাঙা হলেও ঢাকায় তেমন কিছুই না হওয়ার দায় তাকেও নিতে হবে বলে হুঁশিয়ার করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। অবশ্য ওই দুই নেতা আলাপকালে বলেন, ‘ঢাকা মহানগরের দায়িত্বে থাকে নগর বিএনপি। ব্যর্থ হয়েছে নগর বিএনপি। আমরা ওই কমিটির কিছুই নয়। তা হলে এ দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে কেন?’
তাদের অভিযোগ, আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা কৌশলে খালেদা জিয়াকে দিয়ে ঢাকাকে আট ভাগে ভাগ করে দলের আটজন নেতাকে দায়িত্ব দেন। যাতে আন্দোলনের দায় খোকার ওপর এককভাবে না পড়ে।
এ কাজটি কৌশলে করেছেন তিনি, যার সঙ্গে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও জড়িত বলে তাদের দাবি। সবাইকে অবাক করে দিয়ে আত্মগোপনে থাকা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের নেতাকর্মীদের কাছে ‘ভিলেন’ হলেও খালেদা জিয়াকে ঠিকই ম্যানেজ করে নিয়েছেন। তার ওপর এখনও খালেদা জিয়ার অগাধ বিশ্বাস। যদিও দলের সেকেন্ডম্যান সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার ওপর খুবই ক্ষুব্ধ। এ কথাটি এতদিন গুঞ্জন বলে শোনা গেলেও সম্প্রতি ফাঁস হওয়া এক ফোন বার্তায় তার প্রমাণ মিলেছে।
ওই মোবাইল ফোনবার্তায় তারেক রহমান দলের ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর সঙ্গে কথোপকথনের এক পর্যায়ে মির্জা ফখরুলের ভূমিকা নিয়ে প্রশ তোলেন। কেন তিনি পালিয়ে আছেন, তার কাজ কী এমন কথাও বলেন তারেক রহমান।
জানা গেছে, আন্দোলনের ব্যর্থতার জন্য মির্জা ফখরুলকে অনেকাংশে দায়ী করেন তারেক রহমান। তার ঘনিষ্ঠরা বলছেন, দলের আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণে ভুল করেছেন মহাসচিবসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। ঢাকা মহানগরসহ সারাদেশেই জনগণকে নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিএনপি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। মির্জা ফখরুল আত্মগোপনে যাওয়ায় নেতাকর্মীরা হতাশ হয়েছেন।
জানা গেছে, আত্মগোপনে থাকা নেতাদের অনেকেই এখনও খালেদা জিয়ার মুখোমুখি হচ্ছেন না। বিএনপি চেয়ারপারসন প্রতিদিন তার গুলশানের কার্যালয়ে অফিস করলেও আত্মগোপনে থাকা নেতাদের অধিকাংশই এখনও তার সঙ্গে দেখা করেননি। যারা দেখা করতে গিয়েছেন, তার সবাইকে ‘বকাবকি’ করেছেন তিনি।
বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ছিলেন পুলিশের অন্যতম প্রধান টার্গেট। তার দায়িত্ব ছিল ছাত্রদলকে নানা নির্দেশনা দিয়ে আন্দোলনের মাঠে সক্রিয় রাখা। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে নানাভাবে ছাত্রদলকে দিয়ে ঢাকার আন্দোলন ধরে রেখেছিলেন তিনি। তবুও তাকে শুনতে হচ্ছে ব্যর্থতার জন্য ভৎর্সনা।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলেও শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেন, ছাত্রদলের শীর্ষস্থানীয় সকল নেতার সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। আন্দোলনের মাঠে তাদের সক্রিয় রাখতে কাজ করেছেন তিনি। তার দায়িত্ব তিনি পালন করার চেষ্টা করেছেন।
তিনি বলেন, ‘ছাত্রদল ছাড়াও আমার নির্বাচিত এলাকা লক্ষ্মীপুরের আন্দোলনও দেখভাল করতে হয়েছে। এবারের আন্দোলনে লক্ষ্মীপুরের নেতাকর্মীরা জীবনবাজি রেখে কাজ করেছে। যার নেতৃত্বে ছিলেন তারই অনুসারী নেতাকর্মীরা।’
জানা গেছে, আন্দোলনে ছাত্রদলসহ কয়েকটি অঙ্গ সংগঠনকে সর্বক্ষণিক সহযোগিতা করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। এই নেতার দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকায়ও আন্দোলন হয়েছে অন্য জায়গার চেয়ে বেশি। বলা হয়ে থাকে, মহানগরের মধ্যে তার নির্বাচিত এলাকায়ও আন্দোলন হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এর বাইরে ছাত্রদল ও যুবদলের মধ্যে থাকা তার অনুসারীরা ছিলেন সক্রিয়। তারপরও তাদের ‘ব্যর্থতার’ কথা শুনতে হচ্ছে। একইভাবে আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকায়ও আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন নেতাকর্মীরা। তিনিও সর্বক্ষণিক নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করে গেছেন।
সূত্রমতে, কয়েকদিন আগে বিএনপির এক যুগ্ম মহাসচিব খালেদা জিয়াকে ফোন দেয়ার পর তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘তোমাদের দিয়ে কাজ হবে না। তোমরা কিছুই করতে পারনি।’ জবাবে ওই নেতা বলেন, ‘ম্যাডাম আমাদের নির্বাচিত এলাকায় আন্দোলন হয়েছে। ঢাকার দায়িত্বে তো আমরা ছিলাম না। হঠাৎ ঢাকাকে আট ভাগ করে আমাদের দায়িত্ব দেয়া হলেও নগর বিএনপির নেতারা সহযোগিতা করেনি। আমাদের কি করার আছে?
এদিকে খালেদা জিয়া দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘আমি সবাইকে আত্মগোপনে যেতে বলিনি। কয়েকজনকে বলেছি। কিন্তু সবাই আত্মগোপনে চলে গেছেন। তারা আমার নির্দেশ ছাড়া আত্মগোপনে গেছেন, তাদের ব্যর্থতার দায় নিতে হবে।’
এমনও শোনা গেছে, যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ আটক হওয়ার পর আরেক যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে মুখপাত্রের দায়িত্ব দেয়া হয়। তাকে যে কোনোভাবেই গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করার কথা বলা হলেও তিনি তা করেননি। খালেদা জিয়ার নির্দেশনাও নাকি তিনি মানেননি। বারবার অজ্ঞাত স্থান থেকে ভিডিওবার্তা পাঠানোর কারণে তাকে মুখপাত্রের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।
এ ব্যাপারে নেতাকর্মীদের অনেকেই বলছেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীররা তাদের মতো করে খালেদা জিয়াকে বিষয়গুলো বুঝিয়েছেন। অনেকাংশে বিএনপি চেয়ারপারসনকে ভুল মেসেজ দেয়া হয়েছে।
এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, মশিউর রহমান, বিশেষ সম্পাদক নাদিম মোস্তফা, আন্তর্জাতিক সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ অনেকেই মাঠে সক্রিয় ছিলেন না বলে খালেদা জিয়ার কাছে অভিযোগ রয়েছে।
(সূত্র: বর্তমান)