একজন হুমায়ূন আহমেদ

“চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়!
হুমায়ূন আহমেদ চলে গেছেন, তবে তিনি প্রস্থান করেন নি মোটেও।
জুড়ে আছেন আমাদের আঙ্গিনায়, ঘাসের ডগায়, পাখির ডাকে আর নদীর কল্লোলে।
অজর লেখনির সীমাহীন যে গাঁথুনি তিনি রেখে গেছেন, তা ছেড়ে কি চলে যাওয়া যায়? মোটেও না।
ক্ষণিকের এই যাওয়াকে কখনোই বিদায় বলা সমীচীন নয়, এ আমার বিশ্বাস।”
হুমায়ূন স্যার মারা যাওয়ার পর একটি ব্লগে দেখলাম একজন ব্লগার তাঁকে উদ্দেশ্য করে এটি লিখেছেন।

বাংলাদেশের লেখালেখির ভুবনে প্রবাদ পুরুষ হুমায়ূন আহমেদ। গত কয়েক দশক ধরেই তাঁর তুঙ্গসপর্শী জনপ্রিয়তা। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাস দিয়ে সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর আত্মপ্রকাশ। ‘নন্দিত নরকে’ যখন প্রকাশ হয় তখনই বোঝা গিয়েছিলো কথা সাহিত্যের কঠিন ভুবনে তিনি হারিয়ে যেতে আসেননি, থাকতেই এসেছেন। ফলে এদেশের সাহিত্যাকাশে তিনি ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করছেন। মধ্যবিত্ত জীবনের কথকতা সহজ সরল গদ্যে তুলে ধরে পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ কেও রেখেছেন। শুধু মধ্যবিত্ত জীবনের কথকতা বয়ানেই সীমিত নয় তাঁর কৃতিত্ব, বেশ কিছু সার্থক সায়েন্স
ফিকশন-এর লেখকও তিনি। জনপ্রিয় চরিত্র মিসির আলী ও হিমুর স্রষ্টা তিনি- যে দু’টি চরিত্র যথাক্রমে লজিক এবং এন্টি লজিক নিয়ে কাজ করে।

তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই চলচ্চিত্রটি দেখতে প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের ঢল নেমেছিল। মাসের পর মাস ধরে এই চলচ্চিত্রটি বক্স অফিস দখল করে রেখেছিল। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে আটটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে
নিয়েছিল এই ছবিটি। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরেকটি চলচ্চিত্র ‘শ্যামল ছায়া’ বিদেশী ভাষার ছবি ক্যাটাগরিতে অস্কার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। তাঁর অন্য কীর্তি ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রগুলি কেবল সুধীজনের প্রশংসাই পায়নি, মধ্যবিত্ত দর্শকদেরও হলমুখী করেছে বহুদিন পর। টিভি নাট্যকার হিসেবেও তিনি সমান জনপ্রিয়। তাঁর প্রথম টিভি নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’ মধ্য আশির দশকে তাঁকে এনে দিয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়তা। তাঁর হাসির নাটক ‘বহুব্রীহি’ এবং ঐতিহাসিক নাটক ‘অয়োময়ো’ বাংলা টিভি নাটকের ইতিহাসে একটি অনন্য সংযোজন। নাগরিক ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’-এর চরিত্র বাকের ভাই বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছিল টিভি দর্শকদের কাছে। নাটকের শেষে বাকের ভাইয়ের ফাঁসির রায় হলে ঢাকার রাজপথে বাকের ভাইয়ের মুক্তির দাবীতে মিছিল হয়েছিলোবাংলা নাটকের ইতিহাসে এমনটি আর হয়নি কখনো। যখন যুদ্ধাপরাধীদের দাপটে দেশ কাপছে, তখন তিনি তাঁর এক নাটকে তোতা পাখির মুখ দিয়ে বলালেন, “তুই রাজাকার! “। এছাড়াও অসংখ্য বিটিভি ও প্যাকেজ নাটকের নির্মাতা তিনি। নাট্যকার- নির্দেশক দুই ভূমিকায়ই সমান সফল।
সফল শিল্পের আরেকটি শাখা চিত্রকলাতেও। তাঁর চিত্রশিল্পের স্বাক্ষর নিজ বাড়ির দেয়ালে টাঙানো রয়েছে।

মাঝে মাঝে মানে, আমরা এতসব প্রতিভাকে হারিয়ে জাতিগত ভাবেই হুমকির মুখে পড়ছি। গত বছর আমরা হারিয়েছি মিশুক মুনীর এবং তারেক মাসুদকে, যারা ছিলেন চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন সাংবাদিকতার গুরু। মাত্র কিছুদিন আগে আমরা হারালাম হুমায়ুন আহমেদকে, যার অসাধারণ লেখনী শক্তি দ্বারা বাংলা সাহিত্য অনেকাংশেই সমৃদ্ধ হয়েছে। বলা হয়, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম এবং শরতচন্দ্রের পর তাঁর স্থান।
হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুর পর দেশবাসী শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। একটা মানুষের জন্য এত চোখের পানি কেউ দেখেনি আগে। এর থেকেই বোঝা যায়, হুমায়ুন আহমেদের স্থান ছিল কতটা উপরে। হুমায়ুন আহমেদেও প্রস্থান বাংলা সাহিত্যে এক বিশাল শূন্যতা তৈরী করলো। তাঁর এই শূন্যস্থান কেউ পূরণ করতে পারবে কিনা সন্দেহ। কোন বইমেলায় যদি হুমায়ুন আহমেদের বই প্রকাশ হত, সেই বই কেনার জন্য পাঠকদের হিড়িক পড়ে যেত। যেখানে অন্য লেখকদের বই ছাপা হত মাত্র কয়েকশ কপি, হুমায়ুন আহমেদের বই সেখানে ছাপা হত পঞ্চাশ হাজার কপি।

এখন সবকিছুই আছে- কেবল হুমায়ুন আহমেদ নেই; তিনি ছিলেন এবং এই বাংলার আলো বাতাসের মাঝে তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টির জন্যে, তাঁর কাজের জন্যে, তাঁর ভালোবাসার জন্যে। হয়তো জীবন সায়াহ্নের বিষাদ মাখানো র্ট্যাজিক দেয়াল জাতির কাছ থেকে তাঁকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল- কিন্তু শেষ পর্যন্ত, তিনি আমাদেরই লোক- আমাদের হুমায়ুন আহমেদ।

হায়! বিদায় হুমায়ুন স্যার- নশ্বর এই পৃথিবী, নক্ষত্রকে বিদায় জানাতে গেলে চোখ ভেসে যায় জলে। লৌকিকভাবে আপনি আমাদের মাঝে নেই, তবুও আমাদের হৃদয়ে আছেন, থাকবেন।

সৈয়দ তাওসিফ মোনাওয়ার
সম্পাদক, সুনামগঞ্জ মিরর ডটকম

x