বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হল তিনদিনব্যাপী হাসন লোক উৎসব

মরমি কবি হাসন রাজার ১৫৯তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সুনামগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয়েছে তিন দিনব্যাপী হাসনরাজা লোক উৎসব। গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার শহরের সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এ উৎসব শুরু হয়। উৎসবের প্রতিদিনের আয়োজনে ছিল আলচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আলোচনা সভায় বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ বক্তব্য রাখেন।

“সুনামদি থেকে সুনামগঞ্জ। হাওর-বাওর, সবুজঘন গাছ, সুরমার সবুজ জলে ঘেরা এই শহরের সর্বত্রই মিশে আছে একটি নাম, মরমি কবি দেওয়ান হাসন রাজা। শহরের গলিতে গলিতে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবারই সুপরিচিত এই নাম। একইসঙ্গে জারি রয়েছে তার মরমিবাদের চর্চাও।” তিনদিনের হাসন উৎসবে এমনটাই বলেছেন উৎসবে অংশ নেয়া অতিথিরা।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ এমপির সভাপতিত্বে উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নোয়াখালী জেলার সংসদ সদস্য একরামুল কবির চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি ছিলেন দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম, বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক পীর হাবিবুর রহমান, হাসন রাজার উত্তরসূরি সাদিয়া চৌধুরী পরাগন প্রমুখ।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আলোচনা সভার পরে উৎসবে সঙ্গীত পরিবেশন করেন জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের শিল্পীবৃন্দ।

উৎসবের দ্বিতীয় দিন শুক্রবার সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বাংলালিংকের পিআর অ্যান্ড কমিউনিকেশন সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার খন্দকার আশিক ইকবালের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণ সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী।

সালেহ চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে বলেন, স্বল্প জীবনে সময়কে কাজে লাগালে হাসন রাজার মতো অমর হওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, বাংলা ভাষা যতদিন থাকবে, হাসন রাজা ততদিন বেঁচে থাকবেন।

সালেহ চৌধুরী আরো বলেন, একজন মানুষের ভেতরে অনেক মানুষ বসবাস করে। কারও ভেতরে তা মূর্ত হয়, কারও হয় না। সবার ভেতরে এই বোধও জন্মায় না। মরমি কবি হাসন রাজার ভেতরে সেই বোধ জন্মেছিল। চিন্তাশীল মানুষের মাঝে মৃত্যুর ভাবনা আসে। হাসন রাজার মাঝেও এসেছিল। স্বল্প জীবনে মানুষের কতটা কল্যাণে আসা যায় সেই চিন্তা করেছেন হাসন রাজা।

তিনি বলেন, সুনামগঞ্জে প্রতিষ্ঠাতব্য হাসন রাজা একাডেমির নাম পরিবর্তন করে বাউল একাডেমি রাখার চেষ্টা করছেন। অথচ এই এলাকায় কোনো বাউল ছিল না। যদি সন্ধান পাওয়া যায় তাদের চর্চাও করা উচিৎ, তবে অধিক গুরুত্ব থাকবে হাসান রাজার গানে।

আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে লিডিং ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর ইসমত উল্লাহ আহসান বলেন, হাসন রাজাকে ‘রাজা’ বলা যাবে না। কারণ তিনি রাজার চেয়ে অনেক বড় ছিলেন। রাজার আয়েশী জীবন যাপন ছেড়ে তিনি যে সাদামাটা জীবন যাপন করতেন এবং তার মরমিবাদে যে মানবিকতা ছিল তা বর্তমান প্রজন্মে অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। আমাদের পঠন-পাঠনও যে রীতিতে চলছে তাতে কিছু দিন পর রবীন্দ্র নাথ, নজরুলের নামও অনেকে জানবে না। হাসন রাজার আদর্শ ছড়িয়ে দিতে পারলে আমাদের হারানো মানবিকতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন হাসন রাজা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সামারীন দেওয়ান বক্তব্য রাখেন।

আলোচনা সভা শেষে হাসান রত্ন আব্দুল লতিফ, শ্বাশ্বতী চক্রবর্তী, তন্বী দে, হাসন রাজা শিল্পী গোষ্ঠীর শিল্পীরা, দেওয়ান জাফরান রাজা চৌধুরীসহ অন্যান্য শিল্পীরা, রাধা রমন শিল্পী গোষ্ঠীর শিল্পীরা গান পরিবেশন করেন।

রাত ১১টার দিকে অনুষ্ঠানের শেষ আকর্ষন ক্লোজ আপ তারকা সৈয়দ আশিকুর রহমান আশিকের গান শুনতে উৎসুক শ্রোতার ঢল নামে স্কুল মাঠ প্রাঙ্গণে। এসময় ‘আমি না লইলাম আল্লাজির নাম’, ‘কানাই তুমি খেয়র খেলাও কেনে’ সহ মোট আটটি গান পরিবেশন করেন তিনি।

উৎসবের সমাপণী দিন শনিবার সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী তাঁর বক্তব্যে বলেন, হাসনরাজার দেশ সুনামগঞ্জ, আর আমার বাড়ি মৌলভীবাজার। তবুও হাসন পরিবারের প্রতি আমার আত্মার টান। হাসনরাজা থেকে শুরু করে আব্দুল করিম, এঁদের সবার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা রাখতে হবে। হাসনরাজা শুধু সুনামগঞ্জের নন, তিনি পুরো বাঙ্গালীর।

শনিবার রাত দশটায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রী উৎসবের সমাপনী দিনের আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী।

হাসনরাজা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সামারিন দেওয়ানের সঞ্চালনায় ও দেওয়ান শমসের রাজা চৌধুরীর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক পীর হাবিবুর রহমান, সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার হারুন-অর-রশীদ।

সৈয়দ মহসিন আলী তাঁর বক্তব্যে আরো বলেন, আমি একসময় মৌলভীবাজারের পৌর চেয়ারম্যান ছিলাম, মউজদীনও তখন সুনামগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান। দুজনে মিলে হাসন উৎসবে থাকতাম তখন।
মউজদীনকে বীর আখ্যা দিয়ে সমাজকল্যাণমন্ত্রী সবাইকে মউজদীন স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালনের অনুরোধ করেন।
নিরবতা পালনের পর মন্ত্রী তাঁর বক্তব্যের মধ্যে হাসনরাজার “রঙ্গের খনি যেখানে” গানটি গেয়ে শোনান।

সিলেটি ভাষায় মন্ত্রী বলেন, “আমি রসিক মানুষ, সিলোটি মাত না মাতলে বালা লাগে না, শুদ্ধ বাংলা মাতলে রস অয় না।”

মন্ত্রী বলেন, প্রাণের টানে হাসন উৎসবে আসব, অথচ কিছু মানুষ ফোন দিয়ে বলল উৎসবের আয়োজক নাকি রাজাকাররা! আপনারাই বলেন, হাসনরাজার উৎসব কি রাজাকাররা করে? হালার হালাইন!

পরে তিনি বলেন, আগে নৌকায় করে সুনামগঞ্জ আসতে হতো। এখন রাস্তা হওয়ায় গাড়িতে দিয়ে ফুরুত-ফুরুত করে আসা যায়। যেসব ব্রিজের কাজ হচ্ছে সেগুলো চালু হলে আরো আরামে আসা যাবে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার দেশের উন্নয়ন করছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, বিএনপি তো ইলেকশনো আইলো না, আইলে দেখলো নে রস কিলা লাগে।

বক্তব্যের শেষে হাসনরাজার ”লোকে বলে বলে রে” গানটি গেয়ে শোনান তিনি। এসময় উপস্থিত দর্শকেরা মূুহর্মুহু করতালিতে ফেটে পড়ে।

আলোচনা সভা শেষে হাসনরাজার গান নিয়ে বিশেষ অবদান রাখার জন্য সম্মাননা পদক প্রদান করা হয়। এঁদের মধ্যে মরণোত্তর পদক পেয়েছেন বিদিত লাল দাশ। হাসন পদক পেয়েছেন হাসনরাজা গবেষক অধ্যাপক নৃপেন্দ্রলাল দাশ, সঙ্গীতশিল্পী সেলিম চৌধুরী, দেওয়ান শমসের রাজা চৌধুরী।

পরে হাসনরাজার গানের প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ক্ষুদে শিল্পীদের হাতে পুরষ্কার তুলে দেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক পর্বে জাতীয় মানের শিল্পীদের মধ্যে গান পরিবেশন করেন সেলিম চৌধুরী, হিমাংশু বিশ্বাস ও লাভলী লস্কর।

উৎসবের সমাপণী দিনটিতে জুবিলী স্কুল মাঠে মানুষের ঢল নামে। তিনদিনের এই উৎসব শেষে অনুষ্ঠানস্থল থেকে বাড়ি ফেরা দর্শকদের চোখে-মুখে এক অন্যরকম দীপ্তি লক্ষ করা যাচ্ছিল।

x