‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’

‘ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।

শান-বাঁধানো ফুটপাথে
পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ
কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে
হাসছে।

ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।’

বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ফাল্গুন ও চৈত্র মাস বসন্তকাল। এ ঋতুতে শীতের শুষ্কতা শেষে বিবর্ণ প্রকৃতি ফিরে পায় প্রাণ। গাছে গাছে দেখা দেয় কচি পাতা। দক্ষিণা হাওয়ায় মাতিয়ে তোলে গ্রাম ও শহর। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে বন-বনানী। কৃষ্ণচূড়া, চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, মালতী, মাধবী, বকুল, শিমুল, পলাশসহ নানা জাতের ফুলে সজ্জিত হয়ে উঠছে গ্রামীণ ও শহুরে জনপদ। আমের মুকুলের সৌরভে ম ম করে আকাশ বাতাস। আর এই আগুন লাগা ফাগুনেই গাছে গাছে সুললিত কণ্ঠে প্রিয়াকে ডেকে আকুল হয় বিরহী কোকিল।

আজ বৃহস্পতিবার। পহেলা ফাল্গুন। প্রকৃতির পরতে পরতে রঙের মেলা। ধরণী সেজেছে নতুন সাজে। বসন্তের নতুন হাওয়া লেগেছে মানব মনে। মাতাল সমীরণে মনকেও এলোমেলো করে দেয় নিমিষে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘আহা আজি এ বসন্তে/ এত ফুল ফুটে/ এত বাঁশী বাজে/ এত পাখি গায়/ আহা আজি এ বসন্তে…..।’

দিকে দিকে উঁকি দিচ্ছে বসন্তের সুমধুর প্রহর। জীবনের জাগরণ দ্বারে দ্বারে। দূর নীলিমায় পাখা মেলেছে বিহঙ্গ। আগুন লেগেছে কৃষ্ণচূড়ার ডালে। প্রকৃতির এ পরম আতিশয্যের মাঝেও কোন কোন মন হু-হু করে বেদনায়। প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যথা। অতীতের চরম হতাশা। কোথাও কেউ না থাকার হাহাকার জয় করতে মরিয়া হয়ে ওঠে মানুষ। কৃষাণের ঘামে চিকচিক করে কৃষাণির আগামীর স্বপ্ন। কিশোরীর মনে উঁকি দেয় অজানা অনুভূতি। স্বপ্নবিভোর কিশোরের চোখে ধরা প্রথম মানবীয় প্রেম।
সব ভুলেও মানুষ একটু হেসে ওঠে। বেঁচে থাকার জন্যই তার হেসে ওঠা। সে হাসি ছড়িয়ে যায় বসন্তের আকাশে-বাতাসে। বসন্তের সাথে গড়ে ওঠে সখ্যতা। অতীতের গ্লাণি ভুলে যায় মুহূর্তে। সুখী আগামীর প্রত্যাশায় আবার নতুন করে ভালোবাসতে চায়। বাঁচতে চায়-কাছে টেনে নিতে চায়।

ফাগুনের প্রথম দিনে বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে পথে নামে তন্বী-তরুণীরা। নতুন ফুলে খোঁপা সাজায়। অসংখ্য রমণীর বাসন্তী রঙে রঙিন হয়ে ওঠে রাজধানীর রাজপথ, পার্ক, একুশের বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুশোভিত সবুজ চত্বরসহ পুরো রাজধানী। তরুণরাও আজ পরবে বাসন্তী রঙের পোশাক। প্রকৃতির ছোঁয়া নিতে তারাও বেরিয়ে পড়বে। বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা পরিণত হবে প্রেমিক-প্রেমিকাদের মিলনমেলায়। একে অন্যের হাতে তুলে দেবে প্রিয় কোনো কবির কবিতার বই কিংবা ভালোবাসার গল্প। অসাম্প্রদায়িক উৎসবের রং ছড়িয়ে পড়বে সারা শহরে। আর পিছিয়ে নেই গ্রামও। নানা আয়োজনে বসন্তকে বরণ করে নেন সহজ-সরল মাটির মানুষগুলো।

বসন্ত বরণ বাঙালির জাতীয় জীবনের উল্লেখযোগ্য একটি অনুষ্ঠান। চিরায়ত গ্রামবাংলার ঐতিহ্যকে লালন করেই পালন করা হয় ঋতুরাজ বসন্তকে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই কাধে কাদ মিলিয়ে শামিল হয় এ উৎসবে। মুহূর্তেই ভুলে যায় যাবতীয় ক্ষোভ-হিংসা-দ্বেষ। ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে দেয় সকলের মন। ফাগুন হাওয়ায় যৌবনের নতুন পথ চলার আরম্ভ। সর্বত্রই নতুনত্বের ছোয়া।

সব মিলিয়ে বসন্তকে বরণ করে নিতে প্রতিবছরই তৈরি হয় দেশ। এবারও তার কমতি নেই। বসন্তের প্রথম দিনে নানা আয়োজনে আলোড়িত হবে রাজধানী ঢাকা। জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ বরাবরের মতো বসন্ত উৎসবের আয়োজন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলার পাশাপাশি এবার পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক ও ধানমণ্ডির রবীন্দ্রসরোবর মুক্তমঞ্চে বসন্তকে বরণ করা হবে। বসন্তের প্রকৃতি বর্ণনা ও বন্দনা করা ছাড়াও এসব মঞ্চ থেকে বাঙালির জীবনে বসন্তের প্রভাব নানা ব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তোলা হবে।

x