পদোন্নতি বঞ্চিত বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা
চাকুরী জীবনের শেষদিকে এসেও পদোন্নতি না পেয়ে আক্ষেপে দিন কাটাচ্ছেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।
তাঁরা হলেন, সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ সৈয়দ মহিবুল ইসলাম এবং একই কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান কল্পনা তালুকদার। তাঁদের দু’জনই বিসিএস ৭ম ব্যাচের কর্মকর্তা। দীর্ঘ ২৬বছর চাকুরী করেও তাঁরা এখনো অধ্যাপক হননি। অথচ ১৪তম ব্যাচের পর থেকে অনেকেই পদোন্নতি অধ্যাপক হয়েছেন।
১৯৮৬ সালে ৭ম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দেন তাঁরা।
চাকুরির শুরুতে সৈয়দ মহিবুল ইসলাম পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন নোয়াখালী সরকারি কলেজে, আর কল্পনা তালুকদার উদ্ভিদবিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে কক্সবাজার সরকারি কলেজে যোগ দেন।
পরবর্তীতে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের পর ফিটলিস্টে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে উপাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান সৈয়দ মহিবুল ইসলাম।
বিভিন্ন তথ্যসূত্র অনুসারে জানা যায়, শিক্ষা ক্যাডারে পদ শূন্য সাপেক্ষে পদোন্নতি হয়। ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি না হওয়ার কারণে একই ক্যাডারেও চলছে সীমাহীন বিশৃঙ্খলা। শিক্ষা ক্যাডারের ২৪তম বিসিএস এর উদ্ভিদবিজ্ঞানের সব কর্মকর্তার পদোন্নতি হয়নি। কিন্তু ইংরেজি বিভাগে কর্মরত ২৪, ২৫ এবং ২৬তম বিসিএস কর্মকর্তাদের পদোন্নতি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উদ্ভিদবিজ্ঞানের ২৪তম বিসিএসের কর্মকর্তাদের জুনিওরেরা পদের দিক দিয়ে উচ্চপদে চলে গেছেন। একই প্রতিষ্ঠানে কে কাকে স্যার সম্বোধন করবেন আর কে কাকে সাহেব সম্বোধন করবেন তা নিয়ে এসব কর্মকর্তারা চরম বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হন।
সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের পদটি অধ্যাপক পদমর্যাদার। কিন্তু উপাধ্যক্ষের পদটি সহযোগী অধ্যাপক সমমানের। অথচ সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদার উপাধ্যক্ষের অধীনে থাকেন বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যাপক। যেসব কলেজের অধ্যক্ষের পদ শূন্য আছে, সেসব কলেজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদার উপাধ্যক্ষ। এরকম অনেক কলেজেই বিভিন্ন বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে আছেন অধ্যাপক। ফলে এখন অধ্যাপক পদ সমমানের বিভাগীয় প্রধানের এসিআর (বার্ষিক চারিত্রিক প্রতিবেদন) দিতে হচ্ছে সহযোগী অধ্যাপক পদ সমমানের কর্মকর্তাকে। এটিকে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা নিজেদের জন্য চরম অবমাননাকর হিসেবে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
তবে অধিকাংশ কলেজেই অধ্যক্ষ বাদে অধ্যাপক পদমর্যাদার কোন পদ নেই। এ নিয়েও কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছে ক্ষোভ ও হতাশা। চাকুরীর নির্দিষ্ট সীমা পেরোনোর পরও শুধুমাত্র পদের সংকটে পদোন্নতি পান না অনেকে, আর পদ না থাকায় অধ্যাপক পদেও পদোন্নতি হচ্ছে না। ফিটলিস্টের মাধ্যমে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে পদায়ন করা হয়।
এসব ব্যাপারে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান কল্পনা তালুকদার বলেন, ১৯৮৬ সালে চাকুরীতে যোগদানের পর গত ২৬বছর যাবত শিক্ষকতা করছি। অন্যান্য বিভাগের অনেক জুনিওরেরা পদোন্নতি পেয়ে অধ্যাপক হয়ে গেছেন, কিন্তু পদ সংকটের কারণে বিজ্ঞানের শিক্ষক হওয়ায় আমি এখনো পদোন্নতি পেয়ে অধ্যাপক হতে পারলাম না। তিনি আরো বলেন, জেষ্ঠ্য কর্মকর্তাদেরকে সুপার নিউমারারি পদ সৃষ্টি কওে প্রমোশন দেয়া উচিত, অন্যথায় ইনসিটু প্রমোশন দেয়া উচিত।
শিক্ষা ক্যাডার ক্যাডার সার্ভিসের অংশ হলেও এটি অন্যান্য ক্যাডারের তুলনায় ভিন্ন। এ প্রসঙ্গে কল্পনা তালুকদার বললেন, অধ্যাপক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে শিক্ষকতার এই পেশায় এসেছিলাম। স্বপ্ন, নামের সাথে একদিন ‘অধ্যাপক’ শব্দটি যুক্ত হবে। কিন্তু চাকুরীর শেষভাগে এসে এখন শঙ্কায় আছি, হয়তো প্রমোশনই হবে না!
বাংলাদেশে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারটি অন্যান্য ক্যাডারের তুলনায় বৃহত্তম একটি ক্যাডার। অথচ বৃহত এই ক্যাডারে পদোন্নতি বঞ্চনায় পড়েছেন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় তিন হাজার শিক্ষক। তারা সবাই বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা। দীর্ঘদিনের এ বঞ্চনায় শিক্ষা ক্যাডারে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। তারা বলেছেন, বিষয়ভিত্তিক পদ শূন্যতায় অনেক ক্ষেত্রেই জুনিয়রদের অধীনে কাজ করতে হচ্ছে সিনিয়রদের। এতে হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে ক্যাডারের পদোন্নতিবঞ্চিত সিনিয়র শিক্ষকদের মধ্যে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায় অনেক বিভাগে অনেক সময় প্রভাষকদের তুলনায় অধ্যাপকের সংখ্যা অনেক বেশি। শিক্ষা ক্যাডারেও বিষয় নির্বিশেষে মন্ত্রণালয় প্রত্যেক শিক্ষককেই সময় (সার্ভিস সময়কাল) এবং অন্যান্য শর্ত পূরণসাপেক্ষে পদোন্নতি দিতে পারে (ইনসিটু প্রমোশন)। এর জন্য শূন্য পদ থাকা না থাকার প্রশ্নটি বিবেচনা করার দরকার পড়ে না। যেমন একটি কলেজে চাকরিরত অবস্থাতেই কোন প্রভাষক সহকারী অধ্যাপকের পদে পদোন্নতি পেতে পারেন। ওখান থেকে শর্ত পূরণসাপেক্ষে সে সহযোগী এবং অধ্যাপক হতে পারেন। দোষ কোথায়? কারণ শিক্ষা ক্যাডারের বৈশিষ্ট্যগত কারণেই কলেজে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রভাষক এবং অধ্যাপকের মধ্যে পার্থক্য নেই। একমাত্র মেচিউরিটি অর্জনের স্থানটি ছাড়া। তা কলেজ পর্যায়ের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তেমন হেরফের করে না। কলেজ প্রশাসন জন্ম তারিখ বিবেচনায় সব ক্ষেত্রে শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা বিবেচনা করবে। এর জন্য শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন এবং বছরে দু’বার নিয়মিত বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির (ডিপিসি) বৈঠকের দরকার পড়বে। কিন্তু যে সময়েই পদোন্নতি পাক, পদোন্নতিপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারিত হবে জন্মতারিখ অনুযায়ী।
বিসিএস প্রশাসন ক্যাডাওে পদোন্নতি হয় ব্যাচভিত্তিক। পদ খালি না থাকলেও কর্মকর্তাদেরকে ইনসিটু প্রমোশন দেয়া হয়, এতে করে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘিত হয় না। কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারে এরকম ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি না থাকায় অনেক জুনিয়রের পদোন্নতি হয়, অথচ সিনিয়র কর্মকর্তারা আগের পদেই চাকরী করেন।
তাছাড়া অনেক উচ্চশিক্ষাপতিষ্ঠানে রয়েছে শিক্ষক সংকট, এমনকি শিক্ষকদের যথেষ্ট সংখ্যক পদও নেই। সেসব কলেজগুলোতে নতুন পদ সৃষ্টি করা হলে শূন্য পদ বাড়ত, পরে এতে একদিক দিয়ে শিক্ষক সংকট দূও হতো, অন্যদিকে অনেকের পদায়ন ও পদোন্নতিও সম্ভব হতো।
সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ সৈয়দ মহিবুল ইসলাম বলেন, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে বিষয়ভিত্তিক পদোন্নতি প্রক্রিয়া চালু থাকায়ই শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির এই জট সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষা ক্যাডার কম্বিনেশন রুলস অনুযায়ী পদোন্নতি চালু থাকলেও এ জট সৃষ্টি হতো না। তিনি আরো বলেন, শুধু পদোন্নতি দিলে হবে না, সরকারি কলেজগুলোতে নতুন পদ সৃষ্টি করতে হবে। অনার্স কোর্স চালু থাকা কলেজগুলোর অধ্যক্ষ, উপাধক্ষ্য ও বিভাগীয় প্রধানের পদগুলোকে উন্নীত (আপগ্রেড) করে অধ্যাপকের মর্যাদা দিতে হবে।
শিক্ষা ক্যাডারের এসব জটিলতা প্রসঙ্গে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে আলাপকালে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক মর্যাদায় শূন্যপদ না থাকায় পদোন্নতি দেওয়া যাচ্ছে না। তবে মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) দেওয়া এক প্রস্তাবে কলেজ পর্যায়ে সুপার নিউমারারি পদ সৃষ্টি করে সংকট নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির তথ্য অনুযায়ী, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের দুই হাজার ৮২৪ জন শিক্ষকের পদোন্নতি হচ্ছে না। এর মধ্যে অধ্যাপক পদেই ৩১২ জনের পদোন্নতি আটকে আছে ২৫ বছর। বিষয়ভিত্তিক পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে এ জট সৃষ্টি হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে এ পর্যন্ত পদোন্নতি আটকে আছে দুই হাজার ৮২৪ জনের। এর মধ্যে ১৯৮৮ সালের সপ্তম বিসিএস থেকে শুরু করে ১৯৯৪ সালের ত্রয়োদশ বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্য থেকে বাংলা, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং, আরবি ও ইসলামী শিক্ষা, গার্হস্থ্য অর্থনীতি, প্রাতিষ্ঠানিক খাদ্য ও ব্যবস্থাপনা, লোকসঙ্গীত এবং পালি বিষয়ের কোনো শিক্ষকের অধ্যাপক পদে পদোন্নতি আটকে না থাকলেও অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, প্রাণিবিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা ও সমাজকল্যাণসহ ৩৯টি বিষয়ের ৮৪৮ জন শিক্ষকের অধ্যাপক পদে পদোন্নতি আটকে আছে।
এদিকে শিক্ষকদের পদোন্নতির এই বঞ্চনা দূর করতে গেল বছরের ১১ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ সংবলিত চিঠি দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। সেই চিঠিতে সুপার নিউমারারি পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতিবঞ্চিত শিক্ষকদের পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সে বিষয়ে কোনো ধরনের অগ্রগতি নেই বলে মাউশি সূত্র জানায়।
দেশে বর্তমানে অধ্যাপক পদের সংখ্যা ৮৭৫টি। এর বিপরীতে পদোন্নতি আটকে আছে ৮৪৮ জনের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিষয়ভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এসব শিক্ষকের পদোন্নতি তাদের চাকরি জীবনে সম্ভব নয়। তাই এই ৮৪৮টি সহযোগী অধ্যাপক পদকে সুপারনিউমারারি অধ্যাপক পদ ঘোষণার সুপারিশ করা হয় অধিদফতরের চিঠিতে।