সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে অনার্সে নতুন ৬টি বিষয় যুক্ত হল
জেলার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে অনার্সে নতুন ৬টি বিষয় চালু হয়েছে। এ খবর জানার পর কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকেরা আনন্দ প্রকাশ করেছেন। সোমবার দুপুরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক (ভারপ্রাপ্ত) ড. মো. আনোয়ার হোসেন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি কলেজের ই-মেইল ঠিকানায় আসে।
অনার্সে যুক্ত হওয়া নতুন ছয়টি বিষয় হল – ইংরেজী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ব্যবস্থাপনা, গণিত এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান।
কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মেজর ছয়ফুল কবীর চৌধুরী বিষয়টি সুনামগঞ্জ মিরর ডটকমকে নিশ্চিত করেছেন।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৫তম অধিভূক্তি কমিটির সুপারিশ এবং অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেট সভার অনুমোদন সাপেক্ষে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে এ ছয়টি বিষয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম সাময়িক অধিভূক্তি প্রদান করা হয়েছে। এবং এসব বিষয়ে সর্বোচ্চ ৫০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করা যাবে।
চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, আগামী এক বছরের মধ্যে প্রতিটি বিষয়ের অনুক’লে অতিরিক্ত ৫০ হাজার টাকা করে সংরক্ষিত তহবিল গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয়কে অবহিত করতে হবে।
এর আগে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সুনামগঞ্জ কলেজকে অনার্স কলেজে উন্নীত করার ঘোষণা করা হয়।
১৯৯৮-৯৯ সালে কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার আলোকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং ৮টি বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি ফি বাবদ ২০ হাজার টাকা জমা দেওয়া হয়। এরপর ২০০১ সালে বাংলা, দর্শন, ইতিহাস এবং হিসাববিজ্ঞান এ ৪ বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু হয়।
কলেজটিতে বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক শ্রেণীতে প্রায় ৫ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ বাদে বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত রয়েছেন ৩৩জন শিক্ষক।
কলেজ সূত্রে জানা যায়, ১৯৪৪ সালের ১ জুলাই ‘সুনামগঞ্জ কলেজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। কলেজটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী স্যার সৈয়দ মুহম্মদ সাদউল্লা। প্রথমে বেসরকারি মিলনায়তন টাউন হলে এর কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৮০ সালের ৩ মার্চ কলেজটি জাতীয়করণ হয় সরকারি কলেজের মর্যাদা লাভ করে। এ কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন প্রফুল্ল কুমার চক্রবর্তী।
বর্তমানে এটিই সুনামগঞ্জ জেলার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও শিক্ষার্থীরা এখানে পড়তে আসেন।
জানা গেছে, অনার্সে বিষয় বৃদ্ধি করা ও মাস্টার্স কোর্স চালু কলেজ কর্তৃপক্ষের দীর্ঘদিনের দাবী। বিভিন্ন সময় কলেজের শিক্ষার্থীবৃন্দসহ ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নও এব্যাপারে দাবী জানিয়ে আসছিল।
দীর্ঘদিন ধরে কলেজের অনার্স বিভাগ চলে আসছিল মাত্র ৪টি বিষয় নিয়ে। বাংলা, ইতিহাস, দর্শন ও হিসাববিজ্ঞান ছাড়া অন্য কোন বিষয়ের অনার্স কোর্স ছিল না। চালু থাকা ৪টি অনার্স কোর্সের সাথে নতুন আরো ৬টি কোর্স যুক্ত হওয়ার খবরে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। এখন মোট অনার্স কোর্সের সংখ্যা হল ১০টি।
বাংলা চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ও ছাত্র ইউনিয়নের কলেজ শাখার সভাপতি অভিজিৎ রায় এ প্রতিবেদককে বলেন, এইচএসসি পাশের পর ভর্তি হওয়ার ব্যাপার নিয়ে একটা দুশ্চিন্তা থেকেই যায় সবার। এখন আমাদের এই কলেজে নতুন ছয়টি বিষয়ে অনার্স চালু হওয়ায় অনেকেই ভাল বিষয়ে পছন্দমত পড়ার সুযোগ পাবে, আর ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই মাস্টার্স কোর্সও চালু হবে। তিনি বলেন, অবিলম্বে কলেজের অবকাঠামোগত সংকট ও শিক্ষক সংকট দূর করার জন্য ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও সিলেটের চৈতন্য প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী রাজীব চৌধুরী বলেন, আমাদের জেলার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে চালু থাকা ৪টি অনার্স কোর্সের সাথে নতুন আরো ৬টি কোর্স যোগ হওয়ায় জেলা শহরেই মানসম্মত উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হবে, আর এতে শিক্ষার্থী ও অভিবাবকদের অধিক অর্থ ব্যয় ও অহেতুক দুশ্চিন্তার অবসান ঘটবে। এখন অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও লোকবল প্রয়োজন।
কলেজের কম্পিউটার অপারেটর ওমর ফারুক জানান, অনার্সে নতুন বিষয় চালু হওয়ার খবরে কলেজের সব শিক্ষক-কর্মচারীরাও আনন্দিত।
কলেজের উপাধ্যক্ষ সৈয়দ মহিবুল ইসলাম বলেন, এখন প্রয়োজন কলেজের অবকাঠামোগত উন্নয়ন। নতুন বিভিন্ন বিষয় চালু হয়েছে, এখন নতুন পদ সৃষ্টি করে প্রয়োজন অনুযায়ী বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের পদায়ন করতে হবে।
কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মেজর ছয়ফুল কবীর চৌধুরী বলেন, তিনি এ কলেজে যোগদানের পর থেকেই উপাধ্যক্ষ মহোদয়কে সাথে নিয়ে অনার্সে বিষয় বৃদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছেন। এবারই এব্যাপারে ইতিবাচক ফল মিলল।
অধ্যক্ষের আশা, শিগগিরই নতুন ছয়টি বিষয় চালুর অনুমোদন মিলবে। ভবিষ্যতে মাস্টার্স কোর্স চালুর মাধ্যমে কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পরিণত করার স্বপ্নের কথা জানান তিনি। তিনি বলেন, নতুন অনার্স কোর্স ও পরবর্তীতে মাস্টার্স কোর্স চালুর মাধ্যমে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজকে শিক্ষার মানের দিক দিয়ে এগিয়ে নিতে পারলেই অধ্যক্ষ হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালনকে স্বার্থক মনে করবেন তিনি।
সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাই সৈয়দ মর্তুজা আলী ১৯৪০ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত সুনামগঞ্জে সাব-ডিভিশনাল কর্মকর্তা (এসডিও) হিসেবে সুনামগঞ্জে কর্মরত ছিলেন।
লেখক সৈয়দ মর্তুজা আলী তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আমাদের কালের কথায়’ এ কলেজ প্রসঙ্গে লিখেছেন- ”কলেজের জন্য চাঁদা সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে আমি গ্রামাঞ্চলে যাই। মরহুম আব্দুল বারি চৌধুরী, উকিল মফিজ চৌধুরী, আব্দুল খালিক আহমদ, আব্দুল হান্নান চৌধুরী, মকবুল হোসেন চৌধুরী প্রমুখ নেতারা এ সময় এগিয়ে আসেন।
প্রথমে পঁচিশ হাজার টাকা চাঁদা সংগ্রহ করে আমরা কলেজের মঞ্জুরীর জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অধ্যাপক জুবের সিদ্দিকী ও সতীশ চন্দ্র ঘোষ কলেজ পরিদর্শন করতে আসেন। তখন তাঁরা বলেন, কলেজ তহবিলে অন্তত পঞ্চাশ হাজার টাকা না থাকলে কলেজের স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সু্নিিশ্চত হওয় যায় না। আমি আবার চাঁদা সংগ্রহের অভিযান শুরু করি ও প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা সংগ্রহ করতে সক্ষম হই। গৌরীপুরের জমিদার বীরেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীকে কলিকাতার ঠিকানায় টেলিগ্রাম করা হলে তিনি পাঁচ হাজার টাকা দিতে সম্মত হন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এ কলেজের স্বীকৃতি দেয়।”