আমার স্বামীকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন মীর কাশেম আলী
ডালিম হোটেল থেকে আমার স্বামীকে পাঁচলাইশ থানার পেছনে ‘সালমা মঞ্জিল’ নামে আলবদরদের একটি টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হাত-পা বেঁধে একটি বাথরুমে আটকে রেখে মীর কাশেম আলী ও অন্যান্য আলবদররা তাকে নির্যাতন করতেন। সালমা মঞ্জিলে আগে থেকেই আরো ১৭-১৮ জন বন্দিকে রাখা হয়েছিল। সেখানে মীর কাশেম আলী আমার স্বামীকে মেরে ফেলার জন্য পাঁচ-ছয়বার চেষ্টা করেছিলেন এবং ১৫-১৬ জন বন্দিকে মেরেও ফেলা হয়েছিল।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা, দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে এসব কথা বলেছেন জুলেখা খান। তিনি কাশেম আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ১৫তম সাক্ষী।
মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ সাক্ষ্য দেন জুলেখা খান। সাক্ষ্যগ্রহণে ট্রাইব্যুনালকে সহযোগিতা করেন প্রসিকিউটর জিয়াদ আল মালুম, সুলতান মাহমুদ সীমন, তাপস কান্তি বল এবং রেজিয়া সুলতানা চমন।
সাক্ষ্য শেষে সাক্ষীকে জেরা করেন মীর কাশেম আলীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। আগামী ১৮ মার্চ মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে ১৬তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
বর্তমানে ৫৭ বছর বয়সী জুলেখা খান চট্টগ্রামের দক্ষিণ খুলশি আবাসিক এলাকার বাসিন্দা। তিনি একজন ফ্যাশন ডিজাইনার এবং একটি ফ্যাশন ডিজাইনিং হাইজের মালিক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ১৪ বছর। তখন তিনি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তেন। তিনি বিএ পাস করেছেন।
সাক্ষীর স্বামী হারুন-অর রশিদ খান একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী সরকারের ১নং সেক্টরের লিঁয়াজো কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনালগ্নে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
সাক্ষ্যে জুলেখা খান উল্লেখ করেন, ১৯৭৬ সালে হারুন-অর রশিদ খানের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের আগে বাবার কাছে জানতে পারি, হারুন-অর রশিদ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমার ভাই শহীদ ওমর ফারুকও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং আমার স্বামীর সঙ্গে তার সখ্যতা ছিল।
জুলেখা খান সাক্ষ্যে জানান, বাবা আব্দুল বারীর কাছে থেকে থেকে তিনি জানতে পেরেছিলেন আলবদর কমান্ডার মীর কাশেম আলী তার স্বামী হারুন-অর রশিদ খানকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করেছিলেন।
তিনি আরো জানান, চট্টগ্রাম শহরের পাঁচলাইশ থানার পেছনে ‘সালমা মঞ্জিল’ নামে আলবদরদের টর্চার সেলে থাকাকালে মীর কাশেম আলী তার স্বামীকে মেরে ফেলার জন্য পাঁচ-ছয়বার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেখানে ১৫-১৬ জন বন্দিকে মেরে ফেলা হয়েছিল।
দায়িত্ব পালনকালে ১৯৭১ সালের ২৮ নভেম্বর সকাল দশটা সাড়ে দশটা-এগারটার দিকে চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক চায়ের দোকান থেকে মীর কাশেম আলীর নেতৃত্বে আলবদররা হারুন-অর রশিদ খান এবং তার সহকর্মী শহিদুল আলমকে তুলে ডালিম হোটেলে নিয়ে যান। সেখানে তাদের তিন-চারদিন ধরে নির্যাতন করা হয়।
সাক্ষী বলেন, পরবর্তীতে ডালিম হোটেল থেকে আমার স্বামীকে পাঁচলাইশ থানার পেছনে ‘সালমা মঞ্জিল’ নামে আলবদরদের একটি টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হাত-পা বেঁধে একটি বাথরুমে আটকে রেখে মীর কাশেম আলী ও অন্যান্য আল-বদররা নির্যাতন করতেন।
জুলেখা খান সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন, সালমা মঞ্জিলে আগে থেকেই আরো ১৭-১৮ জন বন্দিকে রাখা হয়েছিল, যার মধ্যে শহিদুল আলমও ছিলেন। সেখানে মীর কাশেম আলী তার স্বামীকে মেরে ফেলার জন্য পাঁচ-ছয়বার চেষ্টা করেছিলেন এবং ১৫-১৬ জন বন্দিকে মেরেও ফেলা হয়েছিল।
সাক্ষী বলেন, আমার স্বামীকে না মারার কারণ হিসেবে জানতে পারি, সালমা মঞ্জিলের কোনো এক আলবদর সদস্যের সঙ্গে একে খান পরিবারের শফি সাহেবের মেয়ের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।
শফি সাহেবের স্ত্রীকে সেই আলবদর সদস্য জানান যে, একে খান পরিবারের হারুন খান নামের এক সদস্যকে আটক করা হয়েছে এবং তাকে মেরে ফেলা হবে।
একথা শোনার পর শফি সাহেবের স্ত্রী ওই আলবদর সদস্যকে জানান যে, হারুন খান সম্পর্কে তার মামা হয়। যদি তার কোনো ক্ষতি হয়, তবে মেয়েকে তিনি ওই আলবদরের সঙ্গে বিয়ে দেবেন না। আর এ কারণেই আলবদররা হারুন খানকে হত্যা করেননি বলে সাক্ষ্য দেন জুলেখা খান।
জুলেখা খান আরো উল্লেখ করেন, হারুন খান চট্টগ্রাম কলেজে ‘ছাত্রশক্তি’ নামে একটি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মীর কাশেম আলী একই কলেজে ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। তার স্বামী হারুন খান ২০০১ সালের ২৬ অক্টোবর মারা যান।
গত বছরের ১১ ডিসেম্বর শুরু হয়ে মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন আরও ১৪ জন সাক্ষী। তারা হলেন সৈয়দ মো. এমরান, মো. সানাউল্লাহ চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী, সুনীল কান্তি বর্ধন দুলাল, শহীদপুত্র শিবু দাস, মৃদুল কুমার দে, প্রদীপ তালুকদার, মুক্তিযোদ্ধা এস্কান্দার আলম চৌধুরী, মো. সালাহউদ্দিন ছুট্টু মিয়া, মো. জাকারিয়া, নাজিমুদ্দিন, মো. হাসান (১), মো. হাসান (২) এবং ফয়েজ আহমেদ সিদ্দিকী।
এর আগে ১৮ নভেম্বর মীর কাশেমের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সিমন ও রেজিয়া সুলতানা চমন।
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর মীর কাশেমের মামলা দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করেন ট্রাইব্যুনাল-১।
৫ সেপ্টেম্বর হত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুন্ঠনের ১৪টি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করে মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল-১।
এর আগে ২১ আগস্ট অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ হয়।
১৬ মে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুমসহ প্রসিকিউশন ১৪টি অভিযোগে মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন। ২৬ মে এ অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।
গত বছরের ৬ মে মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৪টি অভিযোগে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দেন তদন্ত সংস্থা। এ তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করতে মীর কাশেম আলীকে দু’দফা সেফ হোমে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্ত সংস্থা।
গত বছরের ১৭ জুন মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে ওইদিন বিকেলে মতিঝিলে দৈনিক নয়া দিগন্ত কার্যালয়ের (দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশন) থেকে তাকে গ্রেফতার করে বিকেল সোয়া চারটার দিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
ট্রাইব্যুনাল মীর কাশেম আলীকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিলে ওইদিন রাত সাড়ে আটটার দিকে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর ১৯ জুন মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে মীর কাশেমের জামিন আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়।
কাশেম আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে মীর কাশেম আলী ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি ছিলেন। তার নেতৃত্বে আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।
১৪টি অভিযোগের মধ্যে চট্টগ্রামের আসাদনগর ও পাঁচলাইশ এলাকায় আটজনকে নির্যাতনের পর হত্যা ও লাশ গুম এবং ৩৪ জনকে অপহরণের পর চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলে আটকে রেখে নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন ঘটনার অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে। এসব অভিযোগের মধ্যে ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগ ছাড়া বাকি সব কটি অভিযোগেই অপহরণ এবং নির্যাতনের বর্ণনা রয়েছে।
মীর কাশেম জামায়াতের অন্যতম প্রধান অর্থ যোগানদাতা হিসেবে পরিচিত। তিনি ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এবং রাবেতা আল ইসলামী নামে একটি এনজিও’র সাবেক আবাসিক প্রতিনিধি।
জামায়াত সমর্থক বলে পরিচিত দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনেরও চেয়ারম্যান তিনি। ওই প্রতিষ্ঠানেরই সংবাদপত্র দৈনিক নয়া দিগন্ত এবং টেলিভিশন চ্যানেল দিগন্ত টেলিভিশন।
১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসংঘ নাম বদলে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে বাংলাদেশে রাজনীতি শুরু করলে মীর কাশেম আলী তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন।