রাজনীতিতেও শীর্ষে নারীরা
বাংলাদেশে সরকার প্রধানের দায়িত্বে পুরো দুই যুগ ধরে আছেন নারীরা। ১৯৯০ সালে এইচএম এরশাদের পতনের পর থেকে ক্ষমতায় এসেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এখন শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। খালেদা জিয়াও তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবেও এই দুই নারীর সঙ্গে এবার যোগ হয়েছেন রওশন এরশাদ।
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিএনপির মূল কান্ডিরী হয়ে ওঠেন খালেদা জিয়া। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি বিএনপিতে যোগদান করেন। আওয়ামী লীগ ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনাকে তাঁর অনুপস্থিতিতেই দলের সভাপতি নির্বাচিত করে। ১৯৮৬ সালে এই সামরিক শাসক এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিরোধী দলীয় নেতা হন শেখ হাসিনা। ৮০ দশকের শুরুর দিকেই দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কান্ডরী হন দুই নারী। এরপর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার গুরেুত্বপূর্ণ অংশ হন ১৯৮৬ সালে। মাঝে ৪টি বছর জাসদের এ এস এম আব্দুর রব বিরোধী দলীয় নেতার ভূমিকা পালন করেন। তারপর ১৯৯১ সাল থেকে দেশের প্রধান দুটি গুরুত্বপূর্ণ আসন জুড়ে আছেন নারীরা।
১৯৯৬ সালে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর তিনি দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন ২০০৮ সালে ৯ম জাতীয় সংসদের। গত ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদের একতরফা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে তৃতীয় বারের মতো বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলেন আওয়ামী লীগের কান্ডারী শেখ হাসিনা।
১৯৯০ সালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বে এরশাদ বিরোধী দূর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে।শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া অভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদ সরকারকে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন । ১৯৯১ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রধান বিরোধীদল হিসেবে সংসদে বসে। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে শেখ হাসিনা ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হন। এরপর ২০০৮ সালে তিনি কারা মুক্ত হন। একই বছর নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট প্রায় তিন-চতুর্থাংশ আসনে জয়লাভ করে।
অপরদিকে ১৯৯১ সালে ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে খালেদা জিয়া প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৯৬ এর ফেব্র“য়ারিতে অনুষ্ঠিত স্বল্প মেয়াদী সংসদেরও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। একই বছরের জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। খালেদা জিয়া হন বিরোধী দলের নেতা। এরপর ২০০১ সালে আবারো খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী। ২০০৮ সাল থেকে চলতি বছরের আজ ৯ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার দশম সাংসদদের শপথের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত খালেদা জিয়া বিরোধী দলের নেতা ছিলেন।
গত ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা হন রওশন এরশাদ। এই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। রওশন এরশাদের স্বামী এইচ এম এরশাদ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান। এরশাদ এখনো খাতাকলমে দলের প্রধান হলেও মূলত রওশনই চালাচ্ছেন দলটি। দলের নানান সিদ্ধান্ত ও রওশনের প্রভাব দেখে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এমনই ধারণা করেন। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রধান তিনটি দলেন কান্ডারীই এখন নারী।
প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপি চেয়ারপারসন ছাড়াও বাংলাদেশে এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন নারীরা। সংসদের বর্তমান স্পীকার একজন নারী। ২০১৩ সালের এপ্রিলে তিনি দেশের প্রথম নারী স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী শপথ নেন। এরপর দশম জাতীয় সংসদেরও স্পীকার হন তিনি। শিক্ষা, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, আইনশৃংখলারক্ষাকারী বাহিনী, সেনাবাহিনী, ব্যবসা-বানিজ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে এখন নারীরা রয়েছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) দায়িত্ব নিলেন নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম।
বাংলাদেশ সরকারে ও দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীরা প্রধান হলেও সরকারের ভেতরে নারীদের অবস্থান এখনো তেমন মজবুত নয়। গত ৪৩ বছরে বাংলাদেশ সরকারে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, উপদেষ্টা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পদে সাড়ে আটশোরও বেশি পুরুষ জায়গা পেয়েছেন। সেখানে মাত্র ৫০ জনের বেশি নারী এমন পদগুলো পেয়েছেন। অর্থাৎ সরকারের গুরুত্ত্বপূর্ণ পদে ১ শো জন পুরুষের বিপরীতে মাত্র ৫ দশমিক ৮৮ জন নারী জায়গা পেয়েছেন। শতাংশের হিসেবটি ৮৬৪ জন পুরুষ ও ৫৩ জন নারী ধরে। প্রকৃতপক্ষে ৩৫ জন নারী সরকারে থাকার সুযোগ পেয়েছেন। এদের মধ্যে কয়েকজন একাধিকবার সরকারে থাকায় সংখ্যাটি ৫০ ছাড়িয়েছে।
যে নারীরা সরকারে জায়গা পেয়েছেন: শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, মতিয়া চৌধুরী, সাজেদা চৌধুরী, রওশন এরশাদ, মন্নুজান সুফিয়ান, সালমা ইসলাম, ইসমত আরা সাদেক, সাহারা খাতুন, দীপু মনি, মেহের আফরোজ চুমকি, শিরিন শারমিন চৌধুরী, জিনাতুন নেসা তালুকদার, খুরশীদ জাহান হক, সেলিমা রহমান, অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম, সারোয়ারী রহমান, ড.শরিফা খাতুন, ব্যারিষ্টার রাবেয়া ভুঁইয়া, মমতা ওহাব, সৈয়দা রাজিয়া ফয়েজ, তসলিমা আবেদ,কামরুন্নাহার জাফর, আমিনা রহমান,বিনীতা রায়,ফিরোজা বারী,বদরুন্নেসা আহমেদ,নূরজাহান মুরশিদ,ড.নাজমা চৌধুরী,সুলতানা কামাল,রোকেয়া আফজাল রহমান,ইয়াসমিন মুর্শেদ, প্রফেসর সুফিয়া রহমান,গীতি আরা সাফিয়া চৌধুরী ও রাশেদা কে চৌধুরী।