গোলাপগঞ্জে দেশের প্রথম তেলকূপ আবিষ্কার, খনন আগামী মাসে

দেশের একমাত্র তেল কূপ খননের কাজ শুরু হচ্ছে আগামী মাসে। ইতিমধ্যে কূপ খননের লক্ষ্যে রিগ স্থাপন করা হয়েছে। সিলেটে কৈলাশটিলা গ্যাসফিল্ডের ৭নং কূপ দেশের একমাত্র তেল কূপ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কৈলাশটিলা গ্যাসফিন্ড এমএসটি প্লান্টের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ও ৭নং কুপ লোকেশনের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ হারুনুর রশীদ মোল্লা জানান, নতুন আবিস্কৃত এ কূপ খননের জন্য ইতিমধ্যে রিগ ফাউন্ডেশনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে বাপেক্স ফেঞ্চুগঞ্জে কূপ খনন কাজ করছে। এ মাসেই সেখানকার খনন কাজ শেষ হলে রিগ গোলাপগঞ্জের নতুন কূপে বসানো হবে। এছাড়া কূপ এলাকার রাস্তা নির্মাণ, মেশিনারী ফাউন্ডেশনসহ প্রাথমিক পর্যায়ের উন্নয়ন কাজ শেষ হয়েছে। আগামী মাসের প্রথম দিকে ৭নং কূপের খনন কাজ শুরু হবে বলে তিনি জানান।

কৈলাশটিলা তেলক্ষেত্রে আগামী মাস থেকে কূপ খনন কাজ শুরু করবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স)।- বাপেক্স সূত্র বলেছে, কূপ খননের পর এ বছরই তেল উত্তোলন শুরু করা যাবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাপেক্স এর আগে হরিপুর ছাড়া সবখানেই গ্যাস কূপ খনন করেছে। কিন্তু এবার তারা তেল রয়েছে জেনেই কৈলাশটিলায় কূপ খনন করতে যাচ্ছে। কাজেই বাপেক্সের জন্য এটি নতুন অভিজ্ঞতা হবে।

সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের কৈলাশটিলা এবং হরিপুর ক্ষেত্রে ৫৫ মিলিয়ন ব্যারেল উত্তোলনযোগ্য জ্বালানি তেল রয়েছে বলে বাপেক্স পরিচালিত সাম্প্রতিক তৃতীয় মাত্রার ভূকম্পন জরিপে জানা গেছে। সিলেট গ্যাস ফিল্ড সূত্র বলেছে, তেল কূপ খননের জন্য ২৪০ কোটি টাকার ব্যয়ে হবে।

পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসেন মনসুর বলেন, বাংলাদেশ গ্যাসের পর এবার তেল যুগে প্রবেশ করছে। পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, ইতোপূর্বে সামান্য পরিমাণ তেল পাওয়া গেলেও এবার তুলনামূলক বেশি তেল পাওয়ার আশা করা হচ্ছে।

সিলেট গ্যাস ফিল্ড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তফাজ্জেল হোসেন জানিয়েছিলেন, বাপেক্সের তেল কূপ খননের তেমন অভিজ্ঞতা না থাকায় আমরা পরামর্শক নিয়োগ দিয়েছি। আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অভিজ্ঞদের অধীনেই বাপেক্সের খননকারী দল খনন পরিচালনা করবে।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, কৈলাশটিলা ক্ষেত্রে ১২টি স্তরের মধ্যে সাতটি গ্যাস স্তর, চারটি তেল স্তর, একটি গ্যাস এবং তেলের স্তর রয়েছে। এছাড়া হরিপুর ক্ষেত্রে ছয়টি স্তরের মধ্যে চারটি গ্যাসের স্তর একটি তেলের স্তরের নিশ্চিত মজুদ রয়েছে। এছাড়া অন্য একটি স্তরে তেলের মজুদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে গ্যাস স্তরের নিচে তেলের মজুদ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

পেট্রোবাংলার দাবি অনুযায়ী এখান থেকে ৫৫ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উত্তোলন করা সম্ভব। বর্তমান বাজারদর হিসেবে এই তেলের মূল্য ৪২ হাজার কোটি টাকা। এখানে উত্তোলিত তেল চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন করা হবে। তেল উত্তোলন শুরু হলে দেশে জ্বালানি তেলের আমদানি কিছুটা হলেও কমবে।

বাপেক্সের জেনারেল ম্যানেজার (ড্রিলিং) আমজাদ হোসেন এ প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, বাপেক্স ইতোপূর্বে যত কূপ খনন করছে তাতে গ্যাসই পাওয়া গেছে। কেবল হরিপুরে আমরা একটি তেল স্তর থেকে তেল পেয়েছিলাম। তেল এবং গ্যাস কূপ খননের প্রযুক্তি একই ধরনের হওয়ায় বাপেক্সের পক্ষে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তিনি বলেন, হরিপুর থেকে আমরাই প্রথমে দৈনিক ৫০০ ব্যারেল পরে তা ২০০ ব্যারেলে নেমে এসেছিল। এখন আর ওই স্তরে তেল নেই। আমরা এর ওপরে ড্রিলিং করে গ্যাস তুলছি। তবে এবার বিষয়টা হচ্ছে হরিপুরে কূপ খননের আগে আমরা জানতাম না সেখানে তেল রয়েছে। এবার আমরা জেনেশুনে তেল কূপ খনন করতে যাচ্ছি। তিনি বলেন, ইতোপূর্বে উত্তোলন করা তেল পরিশোধনের জন্য রেলগাড়িতে করে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হতো। তবে এবার তেলের পরিমাণ কতটা হবে তা দেখেই পরিশোধনের স্থান নির্ধারণ করা হবে বলে জানান তিনি।

এ্যাপ্রাইজাল অব গ্যাস ফিল্ডস (ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ) (তিতাস, বাখরাবাদ, সিলেট, কৈলাশটিলা এবং রশীদপুর) শীর্ষক প্রকল্পটি ২০০৮ সালে অনুমোদন করে সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে বাপেক্স। এতে ব্যয় হয় ১৬৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি ও বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানির আওতাধীন মোট ১ হাজার ২৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় জরিপ পরিচালনার ফলাফলে কৈলাশটিলা এবং হরিপুরে তেল পাওয়া যায়।

যে দুটি ক্ষেত্রে তেল পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ১৯৮৯ সালে কৈলাশটিলা ক্ষেত্রটি আবিষ্কৃত হয়। ক্ষেত্রটির প্রথম এবং দ্বিতীয় স্তরে ড্রিল স্টিম টেস্ট (ডিএসটি) করে তেলের মজুদ নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে ওই সময় প্রযুক্তি এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে তিন, চার এবং ছয় নম্বর স্তর পরীক্ষা করা হয়নি। এখন তিন হাজার ৩০১, তিন হাজার ৪৬৫ এবং তিন হাজার ৭৮৩ মিটার গভীরতায় তেলের স্তর থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এছাড়া ১৯৮৬ সালে হরিপুর গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। এক হাজার ৯৯১ মিটার গভীরতায় আট দশমিক চার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ২০ মিটার পুরু তেলের স্তর থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ লাখ ৪৪ হাজার ব্যারেল তেল উত্তোলন করা হয়েছে। এখন দুই হাজার ১৫০ মিটার গভীরতায় এক দশমিক তিন বর্গকিলোমিটার এলাকায় ২২ পুরু একটি তেলের স্তর রয়েছে বলে জরিপে জানা গেছে।

গত বছরের শেষ দিকে এ কূপের উন্নয়ন কাজ পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মহসিন আলী গত রোববার ৭ নং কূপ এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এদিকে, গোলাপগঞ্জে অবস্থিত দেশের একমাত্র তেল কুপের উন্নয়ন কাজ পরিদর্শন করেছেন সমাজ কল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী।

গত রোববার কৈলাশটিলা গ্যাসফিল্ডের নতুন আবিষ্কৃত ৭নং কূপের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিদর্শনকালে কৈলাশটিলা গ্যাসফিন্ড এমএসটি প্লান্টের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ও ৭নং কুপ লোকেশনের পিডি মোহাম্মদ হারুনুর রশীদ মোল্লা জানান, ইতিমধ্যে রিগ ফাউন্ডেশনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাপেক্স ফেঞ্চুগঞ্জে খনন কাজ করছে। এ মাসেই সেখানকার খনন কাজ সম্পন্ন হলে রিগ গোলাপগঞ্জের নতুন কুপে বসানো হবে। এছাড়া রাস্তা নির্মাণ,মেশিনারী ফাউন্ডেশনসহ প্রাথমিক পর্যায়ের উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে, আগামী মাসের প্রথম দিকে ৭নং কূপের খনন কাজ শুরু হবে বলে তিনি মন্ত্রীকে অবহিত করেন।

এ সময় গোলাপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আসাদুল হক, কৈলাশটিলা ১নং কুপ লোকেশনরে ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার কামরুল ইসলাম, এমএসটি প্ল্যান্টের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হারুনুর রশীদ মোল্লাসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।

x