প্রথম দেখায় প্রেম, না অন্য কিছু!
সুন্দরী, তবে তার চেয়েও বেশি যা ছিল, তা শুধু তারই ছিল। রূহীন অনুভব করল এই অজানা অচেনা মেয়েটা তাকে চুম্বকের মতো টানছে। শুধু তার চোখে চোখ পড়তেই সে নিজের মধ্যে এক ভালোলাগা অনুভব করল। সে ভালোলাগায় বুঁদ হয়ে থাকা যায় নেশার মতো। আর সেই সঙ্গে একটা কষ্টও অনুভূত হলো, সে তো তার নয়। ফুপিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল তার। নিজের ভেতর এক ধরনের চঞ্চলতা আর অস্থিরতা অনুভব করল সে। এই হলো প্রেমে পড়ার অনুভূতি।
কেউ যখন প্রেমে পড়ে তখন তার ব্রেইনে প্রচুর পরিমাণে ‘ডোপামিন’ এবং ‘নর-ইপিনেফ্রিন’ তৈরি হয়, যে কারণে এমন নেশাগ্রস্তের অনুভূতি হয়।
শুধু মানুষ নয় অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও এমনটা দেখা যায়। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। যেমন স্ত্রী প্রেইরি ভোলকে পুরুষ প্রেইরি ভোলের প্রস্রাবের গন্ধ শোকালে স্ত্রী প্রেইরি ভোলের ব্রেইনে ‘ডোপামিন’ এবং ‘নর-ইপিনেফ্রিন’র মাত্রা বেড়ে যায়।
অন্য এক গবেষণায় দেখা যায় প্রজনন কালে স্ত্রী ভেড়াকে পুরুষ ভেড়ার ছবি দেখালে তার ব্রেইনে নর-ইপিনেফ্রিনের মাত্রা বাড়ে। প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে তা থেকে যায় মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।
বিজ্ঞানীরা বর্তমানে একমত যে, প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ার বিষয়টা সত্যি সত্যি ঘটে। যেসব বিজ্ঞানী এ ক্ষেত্রে কাজ করছেন তারা বিশ্বাস করেন, যেসব সমাজে অস্থিরতা নেই, যুদ্ধ ও মৃত্যুর ঝুঁকি নেই সেসব সমাজে প্রেমে পড়ার সম্ভাবনা তুলনামূলক বেশি। আর এরকম একটা সম্ভাবনার প্রাথমিক শর্ত হলো এমন একটা অনুকূল বিশ্বাস সেই সমাজ ধারণ করবে।
সম্প্রতি প্রকাশিত ভ্যানিটি ফেয়ারের জরিপে তারই প্রতিফলন দেখি আমরা। জরিপটি পরিচালিত হয় নভেম্বর ২০১২’র ১৬-১৯ তারিখ পর্যন্ত। এতে টেলিফোনের মাধ্যমে এক হাজার ১০০ জন প্রাপ্তবয়স্ক অংশগ্রহণ করেন।
জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে ‘সিবিএস নিউজ ডট কম’ গত ২ জানুয়ারি ২০১৩। সিবিএস’র ভাষ্যমতে আমেরিকার শতকরা ৫৬% লোক প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ায় বিশ্বাস করে। তবে যারা বিশ্বাস করেন তাদের মধ্যে বিবাহিত এবং সম্পর্ক আছে এমন লোকের সংখ্যাই তুলনামূলক বেশি।
টিনিট্রি কলেজ ডাবলিনের গবেষকরা ব্রেইন স্ক্যন করে দেখেন ব্রেইনের বিভিন্ন অংশ যেমন মিডিয়াল প্রি-ফ্রোন্টাল করটেক্স স্ন্যাপ জাজমেন্ট (পলক বিচার) এ অংশ নেয়। তাদের এই গবেষণার ফলাফল নভেম্বরে জার্নাল অব নিউরোসায়েন্স এ প্রকাশিত হয়। তারা দেখেন কারও সাথে দেখা হওয়ার কয়েক মিলিসেকেন্ডের মধ্যে তার শারীরিক সৌন্দর্য মূল্যায়িত হয় প্যারা সিংগুলেট করটেক্স’র মাধ্যমে। এবং রস্টোমিডিয়াল প্রি-ফ্রোন্টাল করটেক্সর মাধ্যমে মূল্যয়িত হয় তার সামাজিক সক্ষমতা।
undefined
প্রোফেসর র্যমিরেজ অহিও স্টেট ইউনিভর্সিটির একজন গবেষক। তিনি বলেন, কারও সাথে দেখা হওয়া মাত্রই স্ন্যাপ জাজমেন্টের মাধ্যমে মানুষ বুঝতে পারে তার সাথে কি ধরনের সম্পর্ক হতে যাচ্ছে।
ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমাজিং’র মাধ্যমে ব্রেইন স্ক্যন করে এনড্রিয়াস বারটেল ও সেমির জ্যকি দেখেন যে প্রিয় বন্ধু এবং প্রেমাস্পদের মধ্যে ব্রেইনের প্রতিক্রিয়ার ভিন্নতা আছে। প্রেমাস্পদের ছবি দেখলে ব্রেইনের উভয় পার্শ্বের মিডিয়াল ইনসুলা,এন্টেরিয়র সিংগুলেট করটেক্স ,কডেট নিউক্লিয়াস এবং পুটামেন সক্রিয় হয়। অক্রিয়তা দেখা যায় পোস্টেরিয়র সিংগুলেট জাইরাস, এমিগডালা এবং ডান পার্শ্বের প্রি-ফ্রোন্টাল, প্যারাইটাল ও মিডল-টেম্পরাল করটেক্সে।
ব্রেইন স্ক্যনে আরও দেখা যায় যারা পাগলপ্রায় ভালোবাসেন তাদের ব্রেইনের উত্তেজিত অংশ এবং কোকেইনে আসক্তদের উত্তেজিত অংশ একই। অর্থাৎ উভয় ক্ষেত্রে ব্রেইনের একই জায়গা উত্তেজিত হয়।
এই প্রেমে পড়াটা উভয় পক্ষের একসাথে হলে ভালো, একটি সুন্দর সম্পর্কের সূচনা হয়। না হলে যে প্রেমে পড়ে তার জন্য শুরু হয় এক কষ্টকর জীবন। কথায় বলে প্রেমরোগ বড় রোগ।
মনোবিজ্ঞানী ডরোথি টিনভ এধরনের মানসিক প্রতিক্রিয়ার নাম দিয়েছেন লিমিরেন্ট রিঅ্যাকশন। যার প্রতি এই অনুভূতি হয় অর্থাৎ যার প্রেমে তিনি পড়েন তার নাম দিয়েছেন লিমিরেন্ট অবজেক্ট। লিমিরেন্ট অবজেক্টকে নিয়ে ইনট্রুসিভ চিন্তা আসতে থাকে। ইনট্রুসিভ চিন্তা হলো মনের বিরুদ্ধে চিন্তা আসা। ফলে তা তাকে অমনোযোগী করে ফেলে। পড়াশুনা, কাজে-কর্মে মনোনিবেশ করতে কষ্ট হয়। কখনো কখনো ব্যর্থ হয়।
যেরকম অনুভূতি তার মধ্যে হচ্ছে, সেরকম অনুভূতি যেন লিমিরেন্ট অবজেক্টের মধ্যেও হয় এমনটা প্রত্যাশা করতে থাকে তীব্রভাবে। যদি লিমিরেন্ট অবজেক্টের মধ্যে সামান্য কোনো প্রতিক্রিয়াও সে দেখতে পায় তাহলে ভীষণ আনন্দিত হয়। সব চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি, কাজ-কর্ম লিমিরেন্ট অবজেক্টের প্রতি লক্ষ্য করে চলতে থাকে তার। এমনকি তার জীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ক্রমে ক্রমে বাদ পরে যায়। এক ধরনের পক্ষপাতদুষ্টতা কাজ করে তার মধ্যে। সে লিমিরেন্ট অবজেক্টের নেতিবাচক দিকগুলি দেখতে পায় না। ডিল্যুশন পর্যায়ের এক ভ্রান্ত বিশ্বাসের ফলে সে বিশ্বাস করে লিমিরেন্ট অবজেক্টও তাকে ভালবাসে। এই হল লিমিরেন্ট রিঅ্যাকশন বা প্রেমে পড়ার বিজ্ঞানসম্মত বৈশিষ্ট্য।
তাই প্রেমে পড়ার মধ্যে দিয়ে অনেকেরই দুশ্চিন্তা জনিত সমস্যা, যেমন- জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার, প্যানিক ডিসওর্ডার, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার’র সূচনা ঘটতে পারে। আবার সম্পর্ক না হলে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। কেউ কেউ অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিসঅর্ডারেও ভোগেন।
প্রেম সুন্দর, শাশ্বত। প্রেম মানুষকে মুক্তি দেয় স্থুল যৌনতা থেকে। প্রেমের আগুনে পুড়ে মানুষ খাঁটি হয়। সেই আগুনের রূপ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দিলাম। যাতে অসুস্থতাকে জয় করে সুস্থ সুন্দরভাবে ভালোবাসা যায়।