নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কা

আগামী ২৩ মার্চ যশোর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। আর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে শহর-গ্রামাঞ্চলে।

একদিকে, গোটা সদর উপজেলা ছেয়ে গেছে প্রার্থীদের পোস্টারে পোস্টারে, চলছে ভোটার আকর্ষণে চটকদার মাইকিং। নির্বাচনকে প্রেস্টিজ ইস্যু ধরে প্রচার-প্রচারণায় নেমেছেন যশোরের বাঘা বাঘা নেতারা। অপরদিকে এই উৎসবমুখর পরিবেশের অন্তরালে নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন বিরোধীদলের নেতা থেকে শুরু করে অপরাপর কয়েকজন প্রার্থী। এমনকি সরকারি দলের ব্যানারে থাকা বিদ্রোহী প্রার্থীও ব্যক্ত করেছেন তার সংশয়। এরই মধ্যে এর আগের ৩ ধাপে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার ক্রমশ ঊর্ধ্বগতির বাতাবরণে আতঙ্কের আবেশে জবুথবু এখন যশোর সদরের সাধারণ ভোটাররা। অজানা, অদৃশ্য এক আতঙ্ক যেন ছেয়ে আছে এখন তাদের। নির্বাচনের দিন যত এগিয়ে আসছে, শঙ্কার মাত্রা তত বাড়ছে।

তবে, সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি শাহীন চাকলাদার এসব আশঙ্কা নাকচ করে দিয়েছেন। তার মতে, নির্বাচন সুষ্ঠু আর শান্তিপূর্ণ হবে। তবে গত ১৭ মার্চ সদর উপজেলায় একাধিক নির্বাচনী সভায় সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলাম নির্বাচনে শাহীন চাকলাদার ব্যাপক সহিংতা ঘটাতে পারেন বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।

অভিযোগ এনেছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও সাবেক এমপি খালেদুর রহমান টিটোর ছেলে মাশুক হাসান জয়ও। তার মতে, শাহীন চাকলাদার নিষিদ্ধ সশস্ত্র চরমপন্থি সংগঠনের ক্যাডারদের ভাড়া করেছেন নির্বাচনী সহিংসতা ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করে ফলাফল নিজের অনুকূলে টানার জন্য। এছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগও করছেন পরস্পরের বিরুদ্ধে।

শঙ্কায় ৪ লাখ ৭৮ হাজার ভোটার-
একটি পৌরসভা ও ১৫টি ইউনিয়ন নিয়ে যশোর সদর উপজেলা। এখানে মোট ভোটার ৪ লাখ ৭৮ হাজার ১৮৪ জন। যার মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৪০ হাজার ১৩৯ এবং নারী ভোটার ২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৫ জন।

যশোর নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা যায়, যশোর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটাররা ১৬৫টি কেন্দ্রে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এ লক্ষ্যে ১৬৫ জন প্রিজাইডিং অফিসার, ১ হাজার ৫২১ জন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং ৩ হাজার ৪২ জন পোলিং এজেন্ট দায়িত্ব পালন করবেন।
এ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন চারজন। আর ভাইস চেয়ারম্যান (পুরুষ) পদে ৩ জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে যারা লড়ছেন তারা হলেন, বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত শাহীন চাকলাদার এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও সাবেক এমপি খালেদুর রহমান টিটোর ছেলে মাশুক হাসান জয়, বিএনপি সমর্থিত গোলাম রেজা দুলু ও জাতীয় পার্টি সমর্থিত রুহুল আমিন।

ভোটারদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, তারা এমন একজন জনপ্রতিনিধি চান যিনি সন্ত্রাস ও মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করবেন। এলাকার রাস্তাঘাটসহ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অবদান রাখবেন। কিন্তু ২৩ মার্চের নির্বাচন নিয়ে তাদের মধ্যে রয়েছে নানা শঙ্কা। তাদের ধারণা, যশোরের শার্শা, চৌগাছা ও ঝিকরগাছায় ভোট লুটপাট ও কেন্দ্র দখলের যেসব বিষয়ে তারা অবগত, যশোর সদরেও তেমনটি হবে।

ভোটাররা আরো জানান, চেয়ারম্যান পদে তিনজন প্রার্থী দলীয় ও ব্যক্তিগতভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবেন। ফলে কেউ কাউকে ছাড় দেবেন না। এতে করে সহিংসতার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

যশোর সদর উপজেলার ভোটকে কেন্দ্র করে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন হাইপ্রোফাইল নেতারা। বিশেষ করে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে বেশ কয়েকদিন ধরে প্রচারণা ও কর্মী সমাবেশ করছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শাহীন চাকলাদারকে বিজয়ী করতে মাঠে নেমেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলী রেজা রাজুসহ সিনিয়র নেতারা। সকাল থেকে রাত অবধি সদলবলে বিভিন্ন গ্রাম ও পাড়া-মহল্লায় গিয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ভোট প্রার্থণা করছেন তারা।

আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মাশুক হাসান জয়ের বিজয় নিশ্চিত করতে মাঠে রয়েছেন তার পিতা যশোর-৩ সদর আসনের সাবেক এমপি খালেদুর রহমান টিটো। তিনি প্রতিদিন ছেলের নির্বাচনী প্রচারণায় বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

জাতীয় পার্টি সমর্থিত প্রার্থী রহুল আমিনের পক্ষে মাঠে নেমেছেন দলটির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মাহাবুব আলম বাচ্চু। তিনি নিজেই প্রার্থীকে নিয়ে ভোট প্রার্থনা করছেন।

হাই প্রোফাইল নেতারা ভোটের মাঠে থাকলেও নির্বাচন নিয়ে সহিংসতা ও আতঙ্কের কথা জানিয়েছেন খোদ প্রার্থীরাই। মোট কথা, সীমান্তবর্তী এবং চরমপন্থি প্রভাবিত যশোর সদরের সর্বত্র এখন ২৩ তারিখের নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতার আশঙ্কায় ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করছে। ২৩ তারিখ যত ঘনিয়ে আসছে অদৃশ্য এই আতঙ্ক তত জেঁকে বসছে। নির্বাচনের দিন বা তার আগেপরে কোন মায়ের বুক খালি হয়- এই ভীতির অক্টোপাশ এখন ভোটার এবং তাদের স্বজনদের সবাইকে চোখ রাঙানি দিচ্ছে।

‘একটি পক্ষ’ ভোটডাকাতি করে বিজয় ছিনিয়ে নেবে!-
এ প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান প্রার্থী মাশুক হাসান জয় সাংবাদিকদের বলেন, চরম আতঙ্কে আছি। সাধারণ মানুষ তাদের ভোটটি সুষ্ঠুভাবে দিতে পারবে কি না- এ নিয়েই শঙ্কা। ইতোমধ্যে ‘একটি পক্ষ’ বিভিন্ন স্থানে তাদের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে যে, তারা সন্ত্রাস ও ভোটডাকাতির মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে নেবে। গত শুক্রবার বিকেলে সেই কথাই প্রমাণের চেষ্টা করলেন জয়। তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শাহীন চাকলাদারকে সন্ত্রাসীদের লিডার তথা ‘গডফাদার’ আখ্যা দেন।

তিনি বলেন, পাঁচ বছর ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে শাহীন চাকলাদার বহু সন্ত্রাসীকে অনুসারী বানিয়েছেন। এদের মাধ্যমে তিনি অস্ত্র, মাদক আর চোরাচালানের ব্যবসা করান। তার অভিযোগ, নির্বাচনে ব্যবহারের জন্য শাহীন চাকলাদার আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে চরমপন্থি আসমত, বিল্লাসহ কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের যশোর শহরে জড়ো করছেন। ফলে নির্বাচনী পরিবেশ অশান্ত হয়ে উঠেছে। গত বৃহস্পতিবার ওই সন্ত্রাসী বাহিনী শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সন্ত্রাস করে। যাতে মারাত্মক জখম হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন জয়ের কর্মী আশরাফুজ্জামান ইয়ানক, সোহাগ প্রমুখ। তার দাবি, শাহীন চাকলাদারের কর্মী ফেন্সিডিলের এজেন্ট জাকির গং নাটক করে জয়ের নির্বাচনী কর্মী নান্টু ও মুনিরকে অস্ত্র-মাদকসহ পুলিশের হাতে আটক করিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে মাশুক হাসান জয় বলেন, গডফাদারকে প্রতিহত করতে নির্বাচনে নেমেছি। যশোর সদর উপজেলার মানুষ আমার সঙ্গে আছে। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে রায় আমার পক্ষে আসবে।

জয় অভিযোগ করেন, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে শাহীন চাকলাদারের লোকজন আমার প্রচার মাইক ভাংচুর, পোস্টার ছিড়ে ফেলা, হুমকি-ধামকি দেওয়ার মতো কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছে। তারা গোটা উপজেলাজুড়ে এক ভীতির রাজত্ব কায়েম করতে চাইছে। সদর উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, শঙ্কা বিরাজ করছে স্থানীয় মিডিয়া কর্মীদের মাঝেও। তাই এখানকার পরিস্থিতির বিশ্বাসযোগ্য আর অবাধ সংবাদ আসছে না জাতীয় বা স্থানীয় মিডিয়াগুলোয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সাংবাদিক বলেন-ভাই, আমাদের তো এলাকায় থাকতে হবে! তাই রিপোর্ট করতে হয় বুঝেশুনে। কিচ্ছু করার নেই…

ইন্ধন দিচ্ছেন দুর্নীতিবাজ কিছু পুলিশকর্তা!-
তিনি বলেন, গত পাঁচ বছর উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালে শাহীন চাকলাদার ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি করেছেন। তিনি জনপ্রতিনিধি ইউপি চেয়ারম্যানদের মারধর করেছেন, অপরদিকে সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীদের প্রশ্রয় দিয়েছেন। এসব সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাইছেন। তার এসব অপকর্মে সহায়তা দিচ্ছেন দুর্নীতিবাজ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা।’ ওই পুলিশ কর্মকর্তা আর শাহীন চাকলাদারের আঁতাতে ২৩ তারিখের নির্বাচনে নিরীহ ভোটারসহ সাধারণ মানুষের রক্ত ঝরতে পারে বলেও শঙ্কা বিরাজ করছে এলাকায়।

একটি সূত্র জানায়, শাহীন চাকলাদার নির্বাচনী প্রচারণাকালে বিভিন্ন এলাকায় কৌশলে হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছেন, তার বিরোধীতাকারীদের পুলিশ দিয়ে এলাকা ছাড়া করা হবে। তবে কথাগুলো তিনি সরাসরি বলছেন না, ইশারা-ইঙ্গিতে বোঝাচ্ছেন। এরফলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রচারকর্মীরা আতঙ্কে রয়েছেন, নিজ প্রার্থীর পক্ষে স্বাভাবিক প্রচার চালাতে পারছেন না।

‘অপচেষ্টা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করবে জনগণ’-
শুধু জয় নন, বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী গোলাম রেজা দুলু বলেন, আশঙ্কা করছি, যশোর সদরে শাসকদলের ক্যাডাররা সহিংসতা চালাতে পারে। তারা আমার কর্মীদের হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে পোস্টার সাঁটানো ও প্রচারণায় বাধা দেয়া হচ্ছে।

একই আশঙ্কা প্রকাশ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, শার্শা-চৌগাছার মত যশোর সদরেও তারা ভোটডাকাতির চেষ্টা চালাতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, সচেতন জনগণ তাদের সে অপচেষ্টা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করবে।

‘নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, জনবিচ্ছিন্ন প্রার্থীরা মিথ্যাচার করছেন’-
তবে প্রভাব বিস্তার ও নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কা প্রত্যাখ্যান করেছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার।

বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও যশোর থেকে প্রকাশিত রঙিন দৈনিক সমাজের কথার প্রকাশক-সম্পাদক শাহীন চাকলাদার বলেন, ২৩ মার্চের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। যারা হুমকি-ধামকি, সন্ত্রাস ও ভোটকেন্দ্র দখল হবে বলে মিডিয়ার সামনে বলছেন, আসলে তাদের জনভিত্তি নেই। জনবিচ্ছিন্ন এইসব প্রার্থী সেকারণে মিথ্যাচার করছেন। আওয়ামী লীগ দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। আমাদের লক্ষ-কোটি ভোটার। এই দল থেকে যখন প্রার্থী দেয়, তখন তার বিশাল কর্মীবাহিনী মাঠে থাকে। সুতরাং জনগণ আমার পাশেই আছে।

নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হলে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের রিটার্র্নিং অফিসার ও অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এএনএম মঈনুল ইসলাম বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে প্রশাসন সক্রিয়। নির্বাচনী আচরণবিধি যেন কোনভাবেই লঙ্ঘিত না হয় সে লক্ষ্যে একজন ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্বে আছেন। ভোটের দু’দিন আগে আরও দু’জন অতিরিক্তি ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন।

আর নির্বাচনী পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে ভোটের দিন র‌্যাব, পুলিশ-আনসারের পাশাপাশি সেনাসদস্য থাকবে বলে জানান তিনি।

x