যাব কিভাবে? উপযুক্ত সময়ে ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায় না!

কর্মব্যস্ত জনসমাগমে মুখরিত প্ল্যাটফর্ম। চারদিকে হৈ-হুল্লোড়। টিকিট কাউন্টারের অদূরেই ৭/৮ জন তরূণ-তরূণীর জটলা। চোখে তাদের চিন্তার ছাপ। বেশ ক’জনকে আবার দেখা গেল বিরক্ত হয়ে শ্রাগ করে উঠছেন। বিষয়টি কৌতুহলের জন্ম দিলেও ভদ্রতার ব্যত্যয় হবে ভেবে প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকলাম। নিজের মত এগিয়ে গেলাম কাউন্টারের দিকে। লম্বা লাইনের শেষাংশে দাঁড়িয়ে ওই দলটির কথা ভাবছি। হঠাৎ সংবিৎ ফিরলো সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তির অশ্রাব্য খিস্তিতে। চোখে পড়লো দু’জন যুবক আমাদের লাইনকে এড়িয়ে গিয়ে কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করছে। এ নিয়ে দু’একজন প্রতিবাদ করলেও ওরা সেদিকে ফিরেও তাকালো না। টিকিট হাতে নিয়ে যুবকরা সটান হেটে গেলো সেই তরূণ-তরূণীর জটলার দিকে। বাড়িয়ে দিলো টিকিট আর বিনিময়ে বাগিয়ে নিলো টাকা।

ততক্ষণে ফুরিয়েছে এদিকের দীর্ঘ লাইন। কাউন্টারে কাছে গিয়ে স্বচ্ছ পার্টিশনের এপাশ থেকে বললাম, আংকেল কুলাউড়ার একটা টিকিট প্লিজ। ‘আংকেল’ ঠোট বাঁকা করে উত্তর দিলেন, ভাইস্তা টিকিট নাই। থতমত খেয়ে শুধালাম স্ট্যান্ড বাই আছে? উত্তর, নাই। চিন্তার অথৈ সাগরে আমার নাকানি-চুবানি খাওয়া তখন মনে হলো সবেমাত্র শুরু হয়েছে। কি করবো কোন দিশে পাচ্ছি না। সামনে এগুচ্ছি চোখে পড়লো টিকিট বিক্রেতা সেই যুবকদের। তাদের পাশে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ভাই, কুলাউড়া যাবো। একটা টিকিট ম্যানেজ করতে পারবেন? তাদের জিজ্ঞেস করার নেপথ্যে রয়েছে মিনিট বিশেক আগে দেখা একটি দৃশ্যের অনুপ্রেরণা। জানতে পারলাম কুলাউড়াগামী টিকিটের মুল্য মাত্র ১শ টাকা। তবে খাতির থাকলে ৭০/৮০ টাকা! তাদের সাথে যেহেতু আমার কোন খাতির নেই তাই অগত্যা ১শ টাকাই সই।

সিলেট রেলস্টেশন থেকে আন্তঃনগর জয়ন্তিকা মোটামুটি নির্ধারিত সময়েই ছাড়লো। ট্রেন ছাড়ার সাথে সাথেই শুরু হলো টিকিট কালেকটরদের (টিসি) ব্যস্ততা। যাত্রীদের চেক করতে শুরু করলেন তাঁরা। তবে এটা মোটেই অকারণ ব্যস্ততা বলা যাবে না কারণ বেশিরভাগ যাত্রীর কাছেই টিকিট নেই। কারণ এসব যাত্রীর অনেকেই হয়তো অতিরিক্ত মূল্য দিতে আগ্রহী ছিলেন না কিন্তু তাদের এই ‘অনাগ্রহ’ ‘পৌষমাস’ হয়ে দেখা দিলো টিকিট কালেকটরদের জন্য। ট্রেন যখন সিলেটের মাইজগাঁও স্টেশনে পৌঁছলো শুরু হলো তাদের টিকিট বিক্রির মিশন।

যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল কেন বেশিরভাগ যাত্রীর কাছে টিকিট নেই। তারা জানালেন, উপযুক্ত সময়ে টিকিট পাওয়া যায় না। নিয়ম অনুয়ায়ী স্টেশন থেকে টিকেট দেয়ার কথা থাকলেও সময় মতো কাউন্টারে গিয়েও তা পাওয়া যায় না। অনেক যাত্রী এর পেছনের কারণ হিসেবে বললেন, কৌশল করে ট্রেনের কমকর্তারা সব টিকেট সংগ্রহ করে নেন। আর যাত্রীরা টিকেট কিনতে গেলে স্টেশন মাস্টাররা বলেন, টিকিট শেষ হয়ে গেছে। তখন নিরূপায় যাত্রীরা টিকিট ছাড়াই ট্রেনে চেপে বসেন।

খোঁজ করে জানতে পারলাম ভয়াবহ একটি তথ্য, প্রতিটি স্টেশনের কর্মকর্তাদের যোগসাজসে একটি চক্র গঠন করা হয়েছে। আর এই চক্রই প্রতিটি স্টেশন থেকে সময়ের আগেই সব টিকিট সংগ্রহ করেন। পরে বিপাকে পড়েন যাত্রীরা। এমনকি ট্রেনের ভিতরে চা-পান বিক্রি করা হকাররাও তাদের সহযোগিতা করে।

ত্রেনের ভেতর যাদের পুরো টাকা দেবার সামর্থ্য নেই তাদের জন্য রয়েছে বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা! কিন্তু ‘কিনতে হবে নয়তো ট্রেন থেকে নামতে হবে’ স্লোগানে তারা তাদের টিকিট বাণিজ্য অব্যাহত রাখলেন মোটামুটি সারাপথই। অন্তত কুলাউড়া পর্যন্ত জোরপূর্বক টিকিট বিক্রির এ চিত্র বারবারই দেখা গেছে। হয়তো তা অব্যাহত ছিলো শেষ গন্তব্যস্থল রাজধানী ঢাকা পর্যন্তও যা আমার জন্য হয়ে আছে এক অদেখা অধ্যায়।

x