পরীক্ষা নেবেন শিক্ষামন্ত্রী, অধ্যাপকরা পরীক্ষার্থী
আর কবছরই বা চাকরি! শেষ সময়ে একটু ভালো পদবি অর্থাত্ অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষ হয়ে অবসরে যাওয়ার ইচ্ছা। এতদিন সহজেই প্রায় সবারই এই ‘ইচ্ছাপূরণ’ হয়েছে। কিন্তু এবার থেকে সরকারি কলেজের সিনিয়র অধ্যাপকদের সহজেই ‘ইচ্চাপূরণ’ হচ্ছে না। এখন সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ কিংবা উপাধ্যক্ষ হতে হলে মৌখিক পরীক্ষায় পাস করতে হবে। আর এই প্রথম পরীক্ষা নেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। উল্লেখ্য, এ ধরনের পরীক্ষা দেশে এই প্রথম।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা আদেশে বলা হয়েছে, আগামী ২৫ মার্চ সকাল সাড়ে ৯টা এবং ২টায় অধ্যক্ষ পদে এবং ২৮ মার্চ বিকেল ৩টায় জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সভাকক্ষে উপাধ্যক্ষ পদে আগ্রহী প্রার্থীদের পরীক্ষা নেবেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। মন্ত্রীকে সহযোগিতা করবেন শিক্ষাসচিব ড. মোহাম্মদ সাদিক।
মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, এ ধরনের পরীক্ষার ফলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন একটি বিষয় সংযোজন হচ্ছে। মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য অধ্যক্ষ পদে ১২৫ জন এবং উপাধ্যক্ষ পদে ৫৭ জন সিনিয়র অধ্যাপক আবেদন করেছেন। তাদের নামের তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে (.িসড়বফঁ.মড়া.নফ) প্রকাশ করা হয়েছে। আবেদনকারীদের সবাই বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সদস্য এবং বিভিন্ন সরকারি কলেজে অধ্যাপক পদে কর্মরত। যারা আবেদন করেছেন তারা কলেজ প্রশাসন ঠিকঠাকভাবে চালাতে পারবেন কি না-তা যাচাই করার জন্যই মৌখিক পরীক্ষার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও আরও কয়েকটি বিষয় পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা হবে বলে মন্ত্রণালয়ের কলেজ অনুবিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন। পরীক্ষায় যারা পাস করবেন শুধু তারাই অধ্যক্ষ কিংবা উপাধ্যক্ষ হতে পারবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান বর্তমানকে বলেন, পরীক্ষাটি ‘রাজনৈতিক ভাবে উদ্দেশ্যমুক্ত’ হতে হবে। পরীক্ষার সময় মনে রাখতে হবে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য আমরা যোগ্য লোক বাছাই করব। আর যোগ্য লোক বাছাইয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ করলে ফল খারাপ হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো, আখতারুজ্জামান বলেছেন, পরীক্ষার সময় শুধু আবেদনকারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখলে চলবে না। আবেদনকারীর অন্যান্য যোগ্যতাও পরখ হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এরআগে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে একটি ‘ফিটলিস্ট’ তৈরি করে যোগ্যদের জেলা প্রশাসক পদে পদায়ন করা হত। অন্য ক্যাডার তথা বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের এভাবে পরীক্ষা নিয়ে সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ এবং উপাধ্যক্ষ পদে পদায়ন করা হত না। তদবির আর বাণিজ্যের মাধ্যমে তারা পদ দুটিতে নিয়োগ পেতেন। এতে অনেক কলেজেই যোগ্য অধ্যক্ষ কিংবা উপাধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া যেত না। ফলে অনেক সময় সরকারি কলেজের বিভিন্ন ঝামেলা দেখা দিলে অসহায় হয়ে পড়তেন অধ্যক্ষ কিংবা উপাধ্যক্ষরা। এরপরে এসব দিক সামাল দিতে হত শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। ভবিষ্যতে সরকারি কলেজগুলোর সমস্যা যাতে অধ্যক্ষ কিংবা উপাধ্যক্ষরাই মোকাবিলা করতে পারেন এজন্য পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
বেসরকারি একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে সিনিয়র অধ্যাপকদেরকেই সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ কিংবা উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এতে এক ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। সিনিয়র অধ্যক্ষরা ভাবতেন, সিনিয়র হয়ে গেছি, এখন একটু চেষ্টা করলেই যে কোনো কলেজের অধ্যক্ষ হতে পারব। কিন্তু বেশ কয়েকটি কলেজ পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, তারা অধ্যক্ষ হয়ে কলেজের উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারতেন না। এমনকী কলেজের একাডেমিক উন্নয়নেও কী পরিকল্পনা করা যায় তা জানতেন-ই না। শুধু কলেজের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের স্বপ্নে বিভোর থাকতেন। এছাড়া রাজনৈতিক দলের ‘লেজুড়বৃত্তি’র কারণেও কিছু অধ্যাপককে অধ্যক্ষ কিংবা উপাধ্যক্ষ করা হয়। পদ পাওয়ার পর এরা কলেজের উন্নয়ন না করে শুধুমাত্র পদকে টিকিয়ে রাখার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের ‘তোয়াজ’ করতে থাকেন। ফলে বঞ্চিত হয় কলেজ।
একটি উদাহরণ দিয়ে ওই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, রাজশাহী অঞ্চলের একটি কলেজের অধ্যক্ষকে প্রশ্ন করা হয়েছিল-১০ লাখ টাকা মঞ্জুর হলে আপনি আপনার কলেজের জন্য কি কি উন্নয়ন করবেন? উত্তরে ওই অধ্যক্ষ বলেছিলেন, কলেজের ভবনের দেয়াল রং করব, ক্লাসরুমের জন্য বেঞ্চ, ডেক্স তৈরি করব। কিন্তু একাডেমিক উন্নয়নে কি পরিকল্পনা রয়েছে— এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যক্ষ কোনো উত্তর দিতে পারেননি।
ওই গবেষণার শেষ অংশে বলা হয়েছে, কোনো ধরণের যাচাইবাছাই ছাড়াই অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়ার ফলে কলেজ প্রশাসন ভালোভাবে চলছে না। নিয়োগ পাওয়া অধ্যক্ষরা অনেকটা পরিকল্পনাহীনভাবে দিনের পর দিন কলেজ চালিয়েছেন। ফলে কলেজগুলো ভালোমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, গত বছর বরিশালের ঐতিহ্যবাহী বিএম কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে ক্ষমতাসীন দলের একজন শীর্ষ নেতা একজনের নাম সুপারিশ করেন। অথচ ওই সময় কলেজের অধ্যক্ষ পদে কর্মরত ছিলেন বরিশালের সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণের অনুসারী এক অধ্যক্ষ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রভাবশালী নেতার সুপারিশ করা ওই ব্যক্তিকে বিএম কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেয়। আর কর্মরত অধ্যক্ষকে বরিশালের অন্য একটি কলেজে বদলি করে। নতুন নিয়োগ পাওয়া অধ্যক্ষ বিএম কলেজে যোগদান করতে গেলে রাস্তায় ছাত্রলীগের কর্মীরা মারধর করে। এ ঘটনায় তিনি বিএম কলেজে যোগদান করতে পারেন নি। পরে তাকে ওএসডি করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) রাখা হয়। অন্যদিকে কর্মরত অধ্যক্ষকে নতুন করে আরেকটি কলেজে বদলি করে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় মন্ত্রণালয়েরও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। তিনি বলেন, তদবিরের কারণে অধ্যক্ষ নিয়োগ করার কারণেই ‘বুড়ো বয়সে’ ছাত্রলীগের হাতে তিনি মার খেলেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাবে সারাদেশে ২৫২টি সরকারি কলেজ রয়েছে। এসব কলেজের অধিকাংশতেই তদবিরের মাধ্যমে অধ্যক্ষরা নিয়োগ পেয়েছেন। এরফলে কলেজগুলোর প্রশাসন ভালো চলছে না। মূলত কলেজের প্রশাসন ভালোভাবে পরিচালনার জন্য পরীক্ষা নিয়ে অধ্যক্ষ কিংবা উপাধ্যক্ষ নিয়োগের আয়োজন করা হয়েছে।
মাউশি সূত্রে জানা গেছে, এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্যও অনেকে তদবির করছেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতার মাধ্যমে তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যোগাযোগ করছেন। তারা বলছেন, পরীক্ষায় যা-ই হোক না কেন অধ্যক্ষ কিংবা উপাধ্যক্ষ পদে যেন নিয়োগটা হয়ে যায়। তবে এ বিষয়ে প্রায় ১০ জন অধ্যক্ষ ও ৫ উপাধ্যক্ষ পদে আবেদনকারীর সঙ্গে কথা বললেও তারা মুখ খুলতে চাননি।