বেকার সাংবাদিকদের কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি খালেদার
বেকার হয়ে পড়া সাংবাদিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও ১৯ দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়া।
শনিবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে বাংলাদেশে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের(বিএফইউজে) দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন-২০১৪’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
খালেদা জিয়া বলেন, সাংবাদিকদের চাকরি ও কর্মসংস্থান হবে, নতুন পত্রিকা হবে। আগে যদি কিছু নাও করি, এবার কিছু শিখেছি। জাতীয়তাবাদী শক্তিকে আর রাস্তায় থাকতে হবে না, বেকার থাকতে হবে না।
বন্ধ সংবাদ মাধ্যমগুলো অবিলম্বে খুলে দিতে সরকারের প্রতি এ সময় দাবি জানান খালেদা।
আদালতে নিজের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা তুলে ধরে খালেদা বলেন, তিন ঘণ্টা সেদিন কোর্টে বসে থাকলাম। একজন বললেন, চার্জ গঠন করা হয়েছে। কিছু্ বলার সুযোগ দিলেন না। জানলামও না কি চার্জ। জজ সাহেব চলে গিয়ে আদেশ পাঠালেন।
তিনি বলেন, আমরা সুবিচার চাই। কারাগারে থাকা আমাদের নেতাকর্মীদের মুক্তি দিতে হবে। সাংবাদিকদের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। এসব তুলে নিতে হবে।
এ সময় উপজেলা নির্বাচনের পর আন্দোলনের প্রস্তুতির কথা জানান খালেদা জিয়া।
তিনি বলেন, এই নির্বাচনের পর আমাদের আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে হবে। এই আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনকে পদত্যাগ করতে হবে। কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে এই কমিশন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
খালেদা জিয়া বলেন, কোটি টাকা খরচ করে জাতীয় সংগীত গেয়ে লাভ হবে না। জোর করে লোক আনা হয়েছে। অনেক শ্রমিক আহত হয়েছে, অনেকেই নির্যাতিত হয়েছেন। টাকা খরচ করে মানুষ আনতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের টাকা দিয়ে মানুষ আনতে হয় না।
রাস্তায় চলাচলের জন্য কর বসানো প্রসঙ্গে খালেদা বলেন, এবার শোনা যায়, বিভিন্ন রাস্তায় টোল বসাবে। এর প্রতিবাদে জনগণ রাস্তায় নেমে আসবে।
খালেদা বলেন, এখনও টোল দেওয়া হয়। কিন্তু এবার নাকি সাইকেল, রিকশাকেও টোল দিতে হবে। আমাদের ট্রানজিট ব্যবহারের পর তাদের কাছ থেকে টাকা নিলে নাকি বেয়াদবি হবে, তাহলে এবার যে রাস্তা থেকে টোল নেবেন, সেটা কি আদবী হবে?
খালেদা বলেন, দুর্নীতিবাজ যতজন আছেন, তাদের সবাই আওয়ামী লীগে। উপদেষ্টা যে কয়জন আছেন তাদের সবাই দুর্নীতিবাজ।
তিনি বলেন, আজ ব্যাংকগুলোর কী অবস্থা! আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই ব্যাংক ডাকাতি হয়। এটাই তাদের বৈশিষ্ট্য। এর আগেও ক্ষমতায় আসার পর ব্যাংক ডাকাতি হয়েছে। এবার তো সুড়ঙ্গ করে ডাকাতি হয়েছে।
খালেদা বলেন, এবারও অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। পাওয়ার প্লান্টের সঙ্গে অওয়ামী লীগের লোকজন জড়িত। জনগণের ওপর বোঝা চাপানো হয়েছে। গ্যাসের দামও বাড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কারও তাবেদারি মেনে নেব না। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব।
সরকারের সমালোচনা করে খালেদা এ সময় বলেন, সকাল থেকে সন্ধ্যা আমাদের গালি না দিলে তাদের ঘুম হয় না। এই যে আমরা তিস্তার পানি পাচ্ছি না, সীমান্তে যে দেশের মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে কেন কোনো কথা বলা হয় না। আমরা মিছিল করলে গুলি চলে, কিন্তু দেশের মানুষকে মারলে কেন কোনো প্রতিবাদ হয় না।
তিনি বলেন, যে সরকার দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে পারে না, তারা কি ভাবে দেশের দায়িত্ব নেবে? তাই এ সরকারকে বর্জনের সময় এসেছে।
খালেদা সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, সাংবাদিক হত্যার বিচার করে দেখান। কেন সাগর-রুনীর হত্যাকারীরা ধরা পড়ে না। ‘ধরা পড়ে না’ নয়, ধরা হয় না। কারণ এতে সরকারের রাঘব-বোয়ালসহ অনেকেই ধরা পড়ে যাবে।
অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে আবারও জোর দাবি জানান তিনি। খালেদা বলেন, সেই নির্বাচনে যারা জিতবে আমরা মেনে নেব, কোনো আপত্তি থাকবে না। এটা দেশের জনগণের দাবি, সারাবিশ্বের দাবি। সকলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি।
খালেদা বলেন, যেভাবে আন্দোলন করার কথা ছিল, সেভাবে হয়তো হয়নি। কিন্তু প্রেসক্লাব ও সুপ্রিম কোর্টে আন্দোলন হয়েছে। গুন্ডাবাহিনী না পাঠালে আরও বেশি লোকজন হত। গরম ও নোংরা পানি ছিটিয়েছে। মহিলা আইনজীবীর উপর নির্যাতন হয়েছে। শিক্ষকদের উপর নির্যাতন হয়েছে।
তিনি বলেন, আমি হয়তো আসতে পারিনি, আমাদের অনেকেই হয়তো আসতে পারেনি। কিন্তু আন্দোলন থেমে থাকেনি।
খালেদা বলেন, তিনমাস সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। মানুষকে কীভাবে মারা হয়েছে, তার তথ্য আমরা টিম করে পেয়েছি। এই গুম হত্যা এখনো চলছে। এখনই এসব বন্ধ করুন। কেউ এসব করে টিকতে পারেনি।
উপজেলা নির্বাচনে জয়ীদের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, নতুন প্রতিনিধি আসবে, হয়তো আগামী দিনের শক্তি নিয়ে তারা এগিয়ে যাবে।
সারাদেশে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনে বিএনপিপন্থীদের জয়ের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, সারাদেশের অবস্থা এতে বোঝা যায়।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে খালেদা বলেন, অন্যায়ভাবে কাজ করবেন না। এগুলো কাজে আসবে না। এই সরকারের আদেশ-নির্দেশ মেনে দেশের ক্ষতি না করতে তাদের প্রতি আহ্বান জানান খালেদা।
তিনি বলেন, জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। যাদের সঙ্গে জনগণ থাকে, তারা কখনো পরাজিত হয় না। বিএনপি বাসে গান পাউডার দিয়ে মানুষ হত্যা করার আন্দোলন করে না। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করে।
রওশন এরশাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, বিরোধীদল নেতা বলে যিনি নিজের পরিচয় দেন, তিনি বলেছেন, চাপের মুখে পড়ে নির্বাচনে গিয়েছি। চাপতো আমাদেরও ছিল। আমরাতো নির্বাচনে যাইনি। জনগণের কথা ভেবেছি। তাহলে কী চাপে গেছেন? নিশ্চয়ই কোনো অপকর্ম আছে। তার জন্য ব্যবস্থাও নিশ্চয়ই হবে ইনশাল্লাহ। এখনও সময় আছে, যেহেতু বলছেন, নির্বাচন করবেন না। তাই অবিলম্বে পদত্যাগ করে নিজেদের অবশিষ্ট সম্মান বাঁচান।
সরকারের উদ্দেশ্যে খালেদা বলেন, নির্বাচন দিয়ে নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাই করুন। এর কোনো বিকল্প নেই। নিজেদের জনপ্রিয়তা দেখতে নির্বাচন দিন।
তিনি বলেন, এখন সংসদে বিরোধীদল নেই। যারা আছে তারা গৃহপালিত বিরোধীদল। সরকারেও আছে, বিরোধীদলেও আছে। তারা কীভাবে বিরোধীদলের ভূমিকা নেবে।
সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কখনো গুলি চালাইনি, বিরোধী নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা কোনো মামলা দেইনি। তাদের নেতাকর্মীরা রাস্তায় অবস্থান নিয়েছে, পিকনিকও করেছে। তাদের মহিলারা পুলিশের হাতে কামড় দিয়েছে। এতেই তাদের চরিত্র বোঝা যায়।
খালেদা বলেন, আওয়ামী লীগ বারবার গণতন্ত্র হত্যা করেছে। এরশাদ, মইনুদ্দিন, ফখরুদ্দিনসহ বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক সরকার আওয়ামী লীগের সহযোগিতায় ক্ষমতায় এসেছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
খালেদা বলেন, আমার কাছে গেছে অনেকবার বহু প্রস্তাব নিয়ে। আমি বলেছি, এ সবের মধ্যে আমি নাই। সংগ্রাম করে গণতন্ত্র এনেছি। তোমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা বা আপোস আমি করবো না।
খালেদা বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আমরা বলেছিলাম, একদলীয় এই নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে যাবে না। আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষ সেদিন ভোট দিতে যায়নি। বিএনপি এবং জনগণ সফল হয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগ। ১৫৩টি সিটে কোন লোকই পায়নি। তাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে।
তিনি বলেন, সংবাদ পত্রের ছবিতে এসেছে প্রিজাইডিং অফিসার ঘুমাচ্ছে, কুকুর বসে আছে, আর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সিল মারছে। এ সব পত্রিকার প্রত্যেকটি কার্টি আমাদের কাছে আছে।
তিনি বলেন, তারা উপজেলা নির্বাচন দিল। ভেবেছিলো, বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নেবে না। কিন্তু আমরা জানি জন সমর্থন আমাদের আছে। আমরা যখন এগিয়ে আছি দেখতে পেল, তখন শুরু হল শয়তানি।
তিনি বলেন, এখন ভোট হয় না। সকাল আটটা সাড়ে আটটার মধ্যেই ভোট শেষ। আগে থেকেই বাক্স ভরা থাকে। এরপর সিল মারে।
খালেদা বলেন, বাংলাদেশে আজ গণতন্ত্র মৃত। দেশে কোনো সরকার নাই, দেশে এখন অবৈধ সরকার। অন্যায়ভাবে ক্ষমতায় এসেছে, মানুষের উপর অত্যাচার-জুলুম চালাচ্ছে।
তিনি বলেন, সারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা সাংবাদিকদের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, দেশে এখন কী অবস্থা। সংবাদ প্রকাশ যাদের পেশা, সেই সাংবাদিকদের ২৩ জনকে এই সরকার হত্যা করেছে। কোনো পেশার মানুষ এই সরকারের কাছে নিরাপদত নয়। তাই জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা আজ জরুরি।
এ সরকার কথায় কথায় বলে দেশের উন্নতি নাকি করেছে। দেশের উন্নতি কী হয়েছে? উন্নতি হয়েছে ঢেঁকি! উন্নতি হয়েছে আওয়ামী লীগ পরিবারের। সব টাকা লুটপাট করে তারা বিদেশে পাচার করেছে।
সাবেক বিরোধীদল নেতা খালেদা জিয়া বলেন, আজ নামে মাত্র বাংলাদেশ। পরিচালিত হচ্ছে অন্যদেশের দ্বারা। অনেক বিদেশী দেশে কাজ করছেন।
তিনি বলেন, এই আওয়ামী লীগ মুখে মুখেই মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে। তারা মুক্তিযুদ্ধ ও রণাঙ্গণ দেখেনি।
খালেদা মুক্তিযোদ্ধা দলের সমাবেশের কথা তুলে ধরে বলেন, সেদিন যারা সেখানে অংশ নিয়েছেন তারাই সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা। আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা নেই, তারা শরণার্থী মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি বলেন, কথায় কথায় তারা রাজাকারের কথা বলেন। নিজেদের দলে রাজাকার রেখেছেন। এতদিন যিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, তিনিও ছিলেন রাজাকার। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মহলেও বিতর্কিত লোক রয়েছেন বলে ইঙ্গিত করেন খালেদা জিয়া।
তিনি সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্টদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে হবে। নইলে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে না। কারণ এ সরকার গায়ের জোরে ক্ষমতায় বসে আছে।
সংগঠনের একাংশের সভাপতি রুহুল আমিন গাজীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ, ডিইউজে’র সভাপতি আবদুল হাই শিকদার, আয়োজক সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এম আবদুল্লাহ প্রমুখ।
এর আগে সভাপতির বক্তব্যে রুহুল আমিন গাজী বলেন, সাংবাদিকদের প্রতি অকথ্য নির্যাতন অব্যাহতভাবে বাড়ছে। এই সরকার গণমাধ্যমের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এ সময় দেশ গড়ার অঙ্গীকার করেন রুহুল আমিন গাজী।
ডিইউজে সভাপতি আবদুল হাই শিকদার সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতনের পরিসংখ্যান তুলে ধরে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন।
তিনিও জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের ‘প্রথম রাষ্ট্রপতি’ বলে উল্লেখ করলে খালেদা জিয়া তাতে মাথা নেড়ে সায় দেন।
সত্যিকারের স্বাধীন গণমাধ্যমের দিন ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাব সভাপতি সবুজ বলেন, মানুষের মনে এই সরকারের পতন হয়েছে। সরকার হিংস্র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ভিন্নমতের মানুষকে সরাসরি গুলি করছে, কারাগারে প্রেরণ করছে। সরকার বিরোধী মতকে ভয় পায়। নির্বাচনে বিরোধীদলকে দেখতে চায় না।
দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে খালেদা জিয়ার মঞ্চে আসন গ্রহণের পর পবিত্র কুরআন থেকে তেলাওয়াতের মাধ্যমে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি শুরু হয়।
অনুষ্ঠানে বিএনপি ও ১৯ দলের কেন্দ্রীয় নেতারা সহ বিএনপিপন্থি পেশাজীবী নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, সর্বশেষ গত বছরের ১৪ই নভেম্বর অনির্ধারিত এক অনুষ্ঠানে জাতীয় প্রেসক্লাবে যান খালেদা জিয়া। সেদিন প্রেসক্লাবের মেম্বার্স লাউঞ্জে সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা ও চা-চক্রে মিলিত হন তিনি।