আইফেল টাওয়ারের ১২৫ বছর পূর্তি
ফরাসি বিপ্লবের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৮৮৯ সালে প্যারিসে বসেছিল আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর আসর। প্রদর্শনীর প্রবেশপথ হিসেবে লোহালক্কড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল বিশাল এক টাওয়ার। এর পেছনের কারিগর প্রকৌশলী গুস্তাভ আইফেলের নামানুসারে এর নাম রাখা হয় আইফেল টাওয়ার।
আইফেল টাওযার এটা তৈরির আরেকটা কারণ ছিল, বিশ্ববাসীকে দেখানো যে ১০০ বছরে ফ্রান্স বিজ্ঞান ও প্রকৌশলবিদ্যায় কতটা এগিয়ে গেছে। ১৮৮৭ সালের ২৮ জানুয়ারি শুরু হয়েছিল আইফেল টাওয়ারের নির্মাণযজ্ঞ।
বিশাল এই স্থাপনা মেলার পর পরই ভেঙে ফেলা যেত। তা ছাড়া শহরবাসী মোটেই ভালোভাবে নেয়নি টাওয়ারটাকে। অনেকেই বলাবলি করছিল, অহেতুক এই জঞ্জাল প্যারিসের সৌন্দর্যহানি করছে। কিন্তু এত কষ্ট করে তৈরি করা টাওয়ার খুলে নিতে চাননি নির্মাতারা। বরং পরিকল্পনা ছিল, ঠিক ২০ বছর পর ১৯০৯ সালে ভেঙে ফেলা হবে আইফেল টাওয়ার। কিন্তু সেই পরিকল্পনা আর কার্যকর হয়নি। কারণ তত দিনে আইফেল টাওয়ারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে।
পর্যটকরা দল বেঁধে আসতে শুরু করেছে এই ‘আয়রন লেডি’কে দেখতে। আইফেল টাওয়ারের ক্ষুদে সংস্করণের পসরা সাজিয়ে বসেছেন আশপাশের দোকানিরা। বিক্রিও হচ্ছে খুব। টেলিগ্রাফ ও রেডিও সংকেত পাঠানোর কাজেও ব্যবহার করা হয়েছে এই টাওয়ার। যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে যাওয়ায় ভেঙে ফেলার ব্যাপারটা স্থগিত রাখা হলো। সাধারণ লোক তো বটেই, কবি, সাহিত্যিক আর চিত্রকররা এই টাওয়ার দেখে দারুণ সব শিল্প সৃষ্টি করতে শুরু করেছেন।
সব দেখে প্যারিসের মানুষ অবাক। স্বয়ং গুস্তাভ আইফেলও ভাবতে পারেননি, একদিন ফ্রান্সের প্রতীকে পরিণত হবে আইফেল টাওয়ার। নির্মাণকাজ শেষে কিন্তু আইফেল টাওয়ার হয়ে গেল বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু স্থাপনা। ৪১ বছর এই সম্মান ধরে রাখার পর নিউ ইয়র্কে ক্রিসলার বিল্ডিংয়ের কাছে হেরে গিয়েছিল আইফেল টাওয়ার।
তবে ১৯৫৭ সালে একটি অ্যান্টেনা বসানোর পর উচ্চতা দাঁড়িয়েছে ৩২৪ মিটার, ছাড়িয়ে গেছে ক্রিসলার বিল্ডিংকে। সাত হাজার ৩০০ টন ইস্পাত দিয়ে তৈরি হয়েছে এই টাওয়ার। আর লোহার খন্ড ছিল ১৮ হাজার ৩৮টি। ৩০০ জন শ্রমিক এর নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছিল। ১৯২১ সালে ফ্রান্সের প্রথম পাবলিক রেডিও সম্প্রচার শুরু হয় এখান থেকেই। পয়সা খরচ করে লোকে দেখতে যায়, এমন স্থাপনার মধ্যে আইফেল টাওয়ারের নাম সবার আগে। কেবল ২০১১ সালেই ৭ মিলিয়ন বা ৭০ লাখ মানুষ আরোহণ করেছিল আইফেল টাওয়ারে। টাওয়ারটিতে সাধারণ মানুষের জন্য তিনটি তলায় যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে, যার প্রথম দুটি তলায় আছে রেস্টুরেন্ট। প্রতিরাতে প্রতিঘণ্টার প্রতি পুরো পাঁচ মিনিট সুবর্ণ লাইট ঘুর্নায়মান থাকে। আইফেল টাওয়ার-এর মরীচি লাইট শহরকে উজ্জ্বল করে তোলে এবং অন্যরকম একটি পরিবেশ তৈরি হয়।
প্রথম তলায় উঠাতে পূর্ণ বয়স্কদের জন্য ৫.০০ ইউরো, ১২-২৪ বছরের জন্য ৪.০০ ইউরো, ৪-১১ বছরের শিশুদের জন্য ৩.০০ ইউরো এবং প্রতিবন্ধিদের জন্য ৩.০০ ইউরো। দ্বিতীয় তলায় উঠাতে পূর্ণ বয়স্কদের জন্য ৯.০০ ইউরো, ১২-২৪ বছরের জন্য ৭.৫০ ইউরো, ৪-১১ বছরের শিশুদের জন্য ৪.৫০ ইউরো এবং প্রতিবন্ধিদের জন্য ৪.৫০ ইউরো। প্রথম তলায় উঠতে গেলে ৩০০টি সিঁড়ি অতিক্রম করতে হয়। লিফটের ব্যবস্থাও আছে! তৃতীয় তলায় পর্যবেক্ষণ কক্ষ এবং কিছু পরীক্ষাগার আছে। আর আছে গুস্তাভ আইফেলের একটি অ্যাপার্টমেন্ট। এটি এখন জাদুঘর হিসেবে সবার জন্য উন্মুক্ত। সর্বোচ্চ তলায় উঠার জন্য পূর্ণ বয়স্কদের জন্য ১৫.০০ ইউরো, ১২-২৪ বছরের জন্য ১৩.৫০ ইউরো, ৪-১১ বছরের শিশুদের জন্য ১০.৫০ ইউরো এবং প্রতিবন্ধিদের জন্য ১০.৫০ ইউরো।
এ টাউয়ার সপ্তাহে ৭দিনই খোলা থাকে প্রতিদিন সকাল ৯.৩০ থেকে রাত ১২.৪৫ পর্যন্ত ১৬ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত আর বছরের বাকী সময়ের জন্য সকাল ৯.৩০ থেকে রাত ১১.৪৫ পর্যন্ত খোলা থাকে। আইফেল টাওয়ার প্রতি সাত বছর পর পর নতুন রং করা হয়। তা না হলে বিশাল এই টাওয়ারটি মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যাবে যে! সৌন্দর্যের জন্য নিচের দিকে হালকা রং করা হয় এবং ওপরের দিক ক্রমেই গাঢ় রঙে রাঙানো হয়। প্রতিবার রঙে সামান্য পরিবর্তন আনা হয়। সম্পূর্ণ আইফেল টাওয়ার রাঙাতে লাগে প্রায় ৬০ টন রং। ২০১৩ সালে আইফেল টাওয়ারকে রাঙানো হয় ব্রোঞ্জ রঙে। এত বড় স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণ করা হাতি পোষার মতোই বিশাল খরচের ব্যাপার। তাই জীবদ্দশায় প্রায়ই সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে গুস্তাভ আইফেলকে।
একবার মজার ঘটনা ঘটেছিল। রক্ষণাবেক্ষণ খরচের অজুহাত তুলে ভিক্টর লুসটিগ নামের এক চতুর ব্যক্তি ফ্রান্সের ধনীদের আমন্ত্রণ করে জানালেন যে আইফেল টাওয়ার বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফরাসি সরকার! উপযুক্ত দাম দিলে অতিদ্রুত ব্যবসায়ীদের কাছে তা হস্তান্তর করা হবে। এই সুযোগ হারাতে কে চায়? দারুণ লাভের আশায় আর আগপিছ ভেবে দেখল না কেউ। দরপত্র জমা দিল ভিক্টরের দপ্তরে। ভিক্টর নিজেকে পরিচয় দিয়েছিল সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে। সভার দিনই মুখ দেখে ক্রেতা ঠিক করে রেখেছিল সে। পয়সন নামের বোকাসোকা এক ব্যবসায়ীকে জাল কাগজ ধরিয়ে দিয়ে সে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছিল দ্রুত। বোকামির লজ্জায় বেচারা পুলিশের কাছেও কিছু জানায়নি। শোনা যায়, দ্বিতীয়বারের মতো আইফেল টাওয়ার বেচে দেওয়ার চেষ্টাও করেছিল ভিক্টর।
৪ ফেব্রুয়ারি ১৯১২, ফ্রাঞ্জ রেইচেল্ট নামক একজন ফরাসি দর্জি তার নিজের তৈরী প্যারাস্যুট নিয়ে আইফেল টাওয়ারের ৬০ মিটার উচ্চতা থেকে লাফিয়ে পড়েন এবং মৃত্যু বরণ করেন।
১৯১৪ টাওয়ারে অবস্থিত একটি রেডিও ট্রান্সমিটার মানের প্রথম যুদ্ধের (ঞযব ঋরৎংঃ ডধৎ ড়ভ গধৎহব) সময় জার্মান বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসি সেনাবাহিনী নাৎসিদের বেকায়দায় ফেলতে টাওয়ারের অংশবিশেষ ভেঙে ফেলার কথা ভেবেছিল। প্যারিস জার্মানির অধিনস্ত থাকাকালীন ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ফরাসিরা টাওযার রক্ষার্থে লিফটের তার কেটে ফেলে। ফলস্বরূপ এডলফ হিটলারকে পদব্রজে চূড়ায় উঠতে হয়েছিল। তখন এমনটি বলাবলি হতো যে হিটলার ফ্রান্স বিজয় করলেও আইফেল টাওয়ার বিজয় করতে পারেন নি।
৩ জানুয়ারী ১৯৫৬, টাওয়ারের ঊর্ধভাগ আগুনে পুড়ে বিনষ্ট হয়। এরপর ২২ জুলাই ২০০৩, টাওয়ারের সম্প্রচার কক্ষে আগুন ধরে যায়। ৪০ মিনিট পর সম্পূর্ণ আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
২০০৮ ফ্রান্স ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বিতীয়বারের মত সভাপতিত্ব পাওয়ায় ইফেল টাওয়ারে ১২টি দেশের পতাকা লাগানো হয় এবং নীল আলোয় সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দেয়া হয়।
১৪ সেপ্টেম্বর ২০১০, সম্ভাব্য বোমা হামলার আশংকায় আইফেল টাওয়ার দর্শকদের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। অনুসন্ধান চালিয়ে কোন বোমা পাওয়া না যাওয়ায় পরদিন আবারো তা খুলে দেয় হয়। এত কিছুর পরও আইফেল টাওয়ার আজও টিকে আছে মাথা উঁচু করে।
টাওয়ারের পাদদেশে ফ্রান্সের ৭২ জন বিখ্যাত লেখক, কবি ও বিজ্ঞানীর নাম খোদাই করা আছে। পরিষ্কার আবহাওয়ায় আইফেল টাওয়ারের সর্বোচ্চ উচ্চতা থেকে আশপাশের প্রায় ৪২ মাইল এলাকা দেখতে পাওয়া যায়। তাপমাত্রার তারতম্যে আইফেল টাওয়ারের উচ্চতা ছয় ইঞ্চি পর্যন্ত বাড়ে-কমে। ২০০৭ সালে এক নারী আইফেল টাওয়ারকে বিয়ে করেন এবং নিজের নাম বদলে রাখেন এরিকা আইফেল! ঝড়ো বাতাসে টাওয়ারটি ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হেলতে পারে।
একশত পচিঁশ বছর উপলক্ষে তেমন কোনো আয়োজন না থাকলেও নিয়মিত যেভাবে সজ্জিত করা হয় তাতে মনে হয় প্রতিদিনই এর বর্ষপূর্তি উদযাপন হয়।