বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে শেষ হল তিন দিনের লোক উৎসব
সুনামগঞ্জের লোকজ ধারার অন্যতম প্রধান ব্যক্তি শাহ আব্দুল করিমকে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে শনিবার শেষ হলো সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় ও জেলা প্রশাসনের আয়োজনে তিন দিনের লোক উৎসব।
শেষ দিনে শাহ আব্দুল করিমের উপর আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন পৌর মেয়র আয়ুব বখ্ত জগলুল। শাহ আব্দুল করিমের জীবনদর্শন ও সৃষ্টিকর্মের উপর আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন সিলেট-সুনামগঞ্জ সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শামছুননাহার বেগম, মূখ্য আলোচক ছিলেন শিক্ষা সচিব কবি ও গবেষক ড. মোহাম্মদ সাদিক। অন্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন সংস্কৃতি সচিব ড. রণজিৎ কুমার বিশ্বাস, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার সাজ্জাদুল ইসলাম, মুক্তিযোদ্ধা ও আইনজীবী বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু, জাসদ সভাপতি আতম সালেহ ও শাহ আব্দুল করিমের পুত্র শাহ নূর জালাল। আলোচনা সভার সমাপনী বক্তব্য রাখেন জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী।
শিক্ষা সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিক বলেন, ‘রাধারমণ দত্ত, হাসন রাজা ও শাহ আব্দুল করিম আমাদের জাতিগত ঐক্যের প্রতীক। নানা বিভেদের মধ্যে তাঁরা ঐক্যের প্রেরণা হিসাবে প্রতিনিয়ত আমাদের উজ্জীবিত রাখছেন।’ বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ভাবগত দর্শনের উল্লেখ করে ড. সাদিক বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর পাশ্চাত্য সাহিত্যিকরা আমাদের এই দর্শনের পরিচয় পেয়ে চমকে উঠেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যে যে দর্শনের কথা বলেছেন আমাদের রাধারমণ দত্ত, হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিমসহ অসংখ্য মরমি কবিরা সেই দর্শনের কথাই বলে গেছেন। মূলত লোকজ ধারার এইসব শিল্পীরা সকলেই এক ও অভিন্ন সত্যের সন্ধানে নিয়োজিত ছিলেন সারা জীবন।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্দেশ্যে ড. সাদিক বলেন, কবিগুরু আপনি বলেছিলেন, ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’। বিশ্বকবি আপনি আমাদের সুনামগঞ্জে এসে দেখে যান শাহ আব্দুল করিম কত সহজ ভাষায় জীবনের গভীর তত্ত্বকথা বলে গেছেন।’
সংস্কৃতি সচিব ড. রণজিৎ কুমার বিশ্বাস বলেন যে জাতি তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মান দিতে জানে না তারা অকৃতজ্ঞ। আমরা অকৃতজ্ঞ জাতির মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই না। মরমী কবিরা মানুষের কথা বলেছেন। কিন্তু আজকাল মানুষের কথা বলবার লোকজন কমে গেছে। যারা মানুষের কথা বলেন তাঁরা আমাদের প্রণম্য। পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যাকে দুই বার জন্মগ্রহণ করতে হয়। প্রথমে নিজের জন্য, এরপর মানুষের জন্য। মানুষের জন্য যারা জন্মগ্রহণ করেন তাদের মানব জন্মই সার্থক। মরমী কবিদের মধ্যে যে মানবিকতা বোধ তা শিক্ষিতদের মধ্যে দেখা যায় না। সমাজে বিরাজিত সাম্প্রদায়িক ও ছদ্ম সাম্প্রদায়িকদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য বেশি বেশি করে আমাদের লোক শিল্পীদের চর্চা করা উচিত।
বাউল সম্রাট শাহ-আব্দুল করিমের পুত্র নূর জালাল বলেন, “রামকৃষ্ণ বলেছিলেন জন্ম যখন নিয়েছ দাগ রেখে যাও।’ আমি মনে করি মরমী কবিরা সবার মনে দাগ কেটে গেছেন। গান মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করে। মরমী কবিরা মানুষের দুঃখ দুর্দশার কথা তুলে ধরেছেন। শোষকদের হুশিয়ার করেছেন। কৃষক, মজুর, তাঁতি, কামার এক হলে দুঃখের সাগর পাড়ি দেওয়া যায়। মরমী কবিরা তাঁদের গানের মাধ্যমে মানুষকে দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। শাহ আব্দুল করিমের অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। তাই এগুলি যদি সরকারী পৃষ্টপোষকতায় তাহলে তা রক্ষা পাবে। বাংলা সংস্কৃতির আশি ভাগই ভরপুর বাউল গানে।”
সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় গানের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামকে উদ্ব¢ুদ্ধ করেছিলেন শিল্পীরা। মরমী কবিরাও তাঁর গানের মাধ্যমে আমাদের উদ্বুদ্ধ করছেন, করে যাবেন। তাঁদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।
লেখক ও মুক্তিযোদ্ধা-আইনজীবী বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু বলেন, ‘বাউল সম্রট আব্দুল করিম নিরক্ষর কিন্তু স্বশিক্ষিত ছিলেন। তিনি যা করে গেছেন তা অনেক শিক্ষিত জনেরা করতে পারেন নি।’ তিনদিনের লোক উৎসবকে একদিন বাড়িয়ে জেলার অন্যলেঅক কবিদের স্মরণ করার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন হাওর-বাওর ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সুনামগঞ্জে অসংখ্য বাউলের পদচারণা রয়েছে। যা দেশের অন্য কোন অঞ্চলে নেই।
জেলা জাসদের সভাপতি আতম সালেহ বলেন, “আব্দুল করিমের জন্মস্থানে যখন বৈদ্যুতিক আলো ছিল না তিনি তখন স্পর্ধা করে বলেছিলেন ‘আকাশ আমার ছাউনি, আর দুনিয়া আমার ঘর’ তখন তাকে নিয়ে আমার বিষ্ময় লাগে। তাঁর জন্য আমরা সুনামগঞ্জবাসী গর্বিত।” মরমী কবিদের সাথে আরো অন্যান্য বাউলদের জন্য একদিন রাখার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, শাহ আব্দুল করিমের ভাবগুরু সৈয়দ শাহানুর এবং দুর্বিনশাহকে নিয়ে একদিন উৎসব পালন করা যায়।
সংস্কৃতি সচিব ড. রণজিৎ কুমার বিশ্বাস বলেন যে জাতি তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মান দিতে জানে না তারা অকৃতজ্ঞ। আমরা অকৃতজ্ঞ জাতির মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই না। মরমী কবিরা মানুষের কথা বলেছেন। কিন্তু আজকাল মানুষের কথা বলবার লোকজন কমে গেছে। যারা মানুষের কথা বলেন তাঁরা আমাদের প্রণম্য। পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যাকে দুই বার জন্মগ্রহণ করতে হয়। প্রথমে নিজের জন্য আর এর পর মানুষের জন্য। মানুষের জন্য যারা জন্মগ্রহণ করেন তাদের মানব জন্মই সার্থক। মরমী কবিদের মধ্যে যে মানবিকতা বোধ তা শিক্ষিতদের মধ্যে দেখা যায় না। সমাজে বিরাজিত সাম্প্রদায়িক ও ছদ্ম সাম্প্রদায়িকদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য বেশি বেশি করে আমাদের লোক শিল্পীদের চর্চা করা উচিত।
সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শামসুন্নাহার বেগম বলেন, মরমী কবিরা স্বশিক্ষিত ছিলেন। তারা যা সৃষ্ট্রি করে রেখে গেছেন তা অনেক পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে করা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাতবার প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি যা সৃষ্টি করে গেছেন তা কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়। সৃষ্টিকর্তার অসীম করুণার কারণে তা সম্ভব হয়েছিল।
পৌর মেয়র আয়ুব বখ্ত জগলুল বলেন, মরমী কবিদের চিন্তা ভাবনা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। তিনি উৎসব আয়োজনে সম্পৃক্ত সকলকে ধন্যবাদ জানান।
সমাপনী বক্তব্যে জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী বলেন, ‘সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের শহর সুনামগঞ্জ। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের কারণে অন্য বছরের তুলনায় এবছর বিলম্বে মরমী কবিদের লোক উৎসব হয়েছে। জেলার সকলের মধ্যে অসম্প্রদায়িক চেতনা বিরাজমান। আমি মনে করি মরমী কবিদের সৃষ্টির জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে। সারা দেশের সকল অরাজকতা থেকে এ জেলা সবসময়ই মুক্ত।
আলোচনা অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সহকারী জেবুন নাহান শাম্মী ও জোবায়ের আহমদ। আলোচনা অনুষ্ঠানের শুরুতেই কবি ড. মোহাম্মদ সাদিকে প্রেমের কবিতা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা। আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে গভীর রাত পর্যন্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলতে থাকে।
তিনদিনের অনুষ্ঠানের স্পন্সর ছিল লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট লি:। মিডিয়া পার্টনার ছিল বিটিভি, দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর ও এয়ারলিংক।