মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা

তোরা সব জয়ধ্বনি কর!/তোরা সব জয়ধ্বনি কর!/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল-বোশেখীর ঝড়/তোরা সব জয়ধ্বনি কর…।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের এমন দৃপ্তকণ্ঠ উচ্চারণের মধ্য দিয়েই আজ দিবসের সূচনা করবে বাংলাদেশি বাঙালিরা। একই সঙ্গে বিশ্বকবির কালজয়ী সঙ্গীত-‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গেয়ে জাতি স্বাগত জানাবে নতুন বছরকে।

কালের অমোঘ স্রোতে বয়ে যায় সময়। বছর শেষ হয়ে আসে। এর পরিক্রমায় বিদায় নিলো ১৪২০। বিগত বছর যেন জীর্ণশীর্ণ ঝরাপাতাতুল্য।
বিপুল বৈভবে আর সম্ভাবনায় বাংলা নববর্ষ জাগায় নতুন আশা নতুন প্রত্যয়ে। স্বাগত ১৪২১ বঙ্গাব্দ।

নববর্ষের সূর্যোদয়ে নতুন সম্ভাবনা সবুজ পাতার মতো অঙ্কুরিত হবে আমাদের জীবনে, সমাজে—এই প্রত্যাশায় বাংলার হাজার বছরের বহমান লোকজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারায় বর্ষবরণ যুক্ত করেছে অসাম্প্রদায়িকতার এক নতুন অধ্যায়। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায়ই জাতি আজ বরণ করছে বাংলা নতুন বছরকে।

গত বছরের সব অপ্রাপ্তি ভুলে গিয়ে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের লগ্নে একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়েই রোববার বাঙালিরা পালন করবে সার্বজনীন এ উৎসব। নতুন বছরে নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ জাতি আরও সোচ্চার হবে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
বাংলা বছরের প্রথম দিনে গ্রাম ও শহরের ব্যবসায়ীরা খুলবেন হালখাতা। বিভিন্ন স্থানে বসবে বৈশাখী মেলা। দেশের বিভিন্ন জেলা শহরেও বসছে বৈশাখী মেলা। গ্রামবাংলার বৈশাখী মেলা শহরাঞ্চলেও সম্প্রসারিত হয়েছে।

রাজধানীসহ সারা দেশের নানা বয়সী মানুষ সাড়ম্বরে উৎসবের আনন্দে মেতে উঠবে। পোশাক-পরিচ্ছদ, খাওয়াদাওয়া, গানবাদ্য সবকিছুতেই প্রাধান্য পাবে বাঙালিয়ানা।

সকালেই রাজধানীবাসী ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়বে সুসজ্জিত হয়ে। নারীরা পরবেন লাল-সাদা শাড়ি, পুরুষরা পরবেন নকশা করা পাঞ্জাবি ও ফতুয়াসহ বর্ণিল পোশাক।

মঙ্গল শোভাযাত্রা, নাচ, গান, মেলা, নতুন হালখাতা, মিষ্টিমুখ, নতুন পাঞ্জাবি, শাড়ি, ফতুয়া কেনার ধুম, খাওয়া-দাওয়া, বেড়ানো, শুভ নববর্ষ জানানোর রেওয়াজ—উৎসবের নানা অনুষঙ্গে নববর্ষ উদযাপন নিত্যনতুন মাত্রিকতায় উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে চলেছে।

রমনার বটমূলে ষাট দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার নবউন্মেষকালে ছায়ানট সেই যে কাকডাকা ভোরে নববর্ষের আবাহনী গান গেয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ঐতিহ্যের যে সূচনা করেছিল, তা আজ রাজধানীবাসীর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ।
পহেলা বৈশাখে রমনায় ঢাকাবাসী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই লোকজন জড়ো হয়। সোমবার সব পথ যেন মিশে যাবে রমনায় এসে।

স্থানটির পরিচিতি বটমূল হলেও প্রকৃত পক্ষে যে গাছের ছায়ায় মঞ্চ তৈরি হয় সেটি বট গাছ নয়, অশ্বত্থ গাছ। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা।

প্রতিবারের মতো এবারও রাত পোহালেই রাজধানী ঢাকার রমনা অশ্বত্থমূলে নববর্ষের আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানটি শুরু হবে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে।
ছায়ানটের শিল্পীদের রুচিশীল সঙ্গীত-ঝঙ্কার উপভোগ করতে প্রাণের বন্যা বয়ে যাবে রমনায়। ভোরের নরম সূর্যকিরণ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা তবলা, মৃদঙ্গ, পাখোয়াজ আর পুং বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে একটি তাল বাদন পরিবেশনের মধ্যদিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাবেন।
বর্ণিল পোশাকে সজ্জিত অগণিত নারী-পুরুষ-শিশু যোগ দেবেন প্রাণের এ মিলনমেলায়। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠন নানা আয়োজনে পালন করবে বৈশাখ।

পান্তা-ইলিশ পহেলা বৈশাখের উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। তবে এই পান্তা-ইলিশ খাওয়া এখন একশ্রেণীর মানুষের বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে। ইলিশের দাম নাগালের বাইরে থাকায় মধ্যবিত্ত বাঙালির বছরের প্রথম দিনে ইলিশ খাওয়ার সাধ থাকলেও সাধ্য থাকে না কেনার।

রাষ্ট্রপতির বাণী: পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বিশেষ বাণীতে বলেছেন, অতীতের সব গ্লানি ও বিভেদ ভুলে বাংলা নববর্ষ জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমাদের ঐক্য আরও সুদৃঢ় করবে এবং বয়ে আনবে অফুরন্ত আনন্দের বারতা। তিনি বলেন, বাঙালির জীবনে বাংলা নববর্ষের আবেদন চিরন্তন ও সর্বজনীন।

বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে রোববার দেয়া এক বানীতে এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন রাষ্ট্রপতি।

তিনি বলেন, ‘আজ পহেলা বৈশাখ, ১৪২১ বঙ্গাব্দ। শুভ নববর্ষ। বাংলা নববর্ষের এই আনন্দঘন দিনে আমি দেশবাসী ও প্রবাসে বসবাসরত সকল বাংলাদেশিকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই।’

প্রধানমন্ত্রীর বাণী: শেখ হাসিনা দৃঢ় আস্থা ব্যক্ত করে বলেছেন, নববর্ষ সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ও দেশবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি যোগাবে। পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে রোববার এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।

তিনি আশা প্রকাশ করেন, জরা ও গ্লানি মুছে দিয়ে বাঙালির জীবনে ১৪২১ সন সুখ, সমৃদ্ধি ও অনাবিল আনন্দ বয়ে আনবে।

শেখ হাসিনা বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দেশবাসী ও প্রবাসী বাঙালিসহ সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘বাঙালির সার্বজনীন উৎসব-বাংলা নববর্ষ। আমরা নববর্ষকে আবাহন করি প্রাণের স্পন্দনে, গানে-কবিতায়, আবেগের উত্তাপে।’

তিনি আরো বলেন, নববর্ষ মানেই লোকায়ত বাঙালি সংস্কৃতির বর্ণাঢ্য উৎসব। নতুন আশায় উদ্দীপ্ত হওয়ার দিন। আমাদের লেখক, কবি, শিল্পীদের ছন্দ, বর্ণ, তুলি ও সুরে তাই বাংলা নববর্ষ প্রতি বছর নতুন রূপে হাজির হয়।

x