হালখাতার হালহকিকত
হালখাতা বঙ্গাব্দ বা বাংলা সালের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া হলেও হাল আমলে আগের মতো ব্যবসায়ীদের এই আচার চোখে পড়ে না।
নিত্য-নতুন প্রযুক্তির ছোঁয়ায় যেমন ‘খাতা’য় বকেয়া লেখা কমেছে তেমনি আবহমান বাংলা থেকে বিদায় নিতে বসেছে ক্রেতা-বিক্রেতার বন্ধন হালখাতাও।
হালখাতা শুধু হিসাবের নতুন খাতা খোলা নয়, পাওনা আদায়ের পাশাপাশি ক্রেতাদের আপ্যায়নের বিষয়টিও জড়িয়ে আছে হাজার বছরের ঐতিহ্য ‘হালখাতা’য়।
বাংলা বছরের প্রথম দিনে মফস্বল এবং গ্রামাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা বকেয়া আদায়ের এই প্রথা ধরে রাখলেও আধুনিকতার ছোঁয়ায় নাগরিক জীবনে এ ঐতিহ্যের প্রভাব তেমন নেই।
রাজধানীসহ দেশের বেশিরভাগ শহরের বিপণি বিতান কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হালখাতার রেওয়াজ বছরের প্রথম দিনে দেখা যায় না।
তবে রাজধানীর পুরান ঢাকার অনেক ব্যবসায়ী ব্যবসায়ী-খদ্দেরের সর্ম্পককে আজও অমলীন করে রেখেছেন। হালখাতার রেওয়াজ ধরে রেখে এদিন তারা উৎসব উদযাপন করেন।
প্রতিবছরের মতো এবারও তারা বর্ণাঢ্য আয়োজনে বিশেষ করে স্বর্ণ ও মুদী দোকানীরা ক্রেতাদের কাছ থেকে বকেয়া আদায়ের জন্য হালখাতার আয়োজন করেন।
পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার, মৌলভীবাজার, বেগমবাজার, উর্দু রোড, চকবাজার, মোঘলটুলিতে ব্যবসায়ীরা রোববার বছরের শেষ দিনে ধুঁয়ে-মুছে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে নানা ফুল দিয়ে সাজিয়ে তুলছেন তাদের প্রতিষ্ঠান।
অনেক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সামনে ইতোমধ্যে ‘শুভ নববর্ষ’, ‘শুভ হালখাতা’ লেখা ব্যানার-ফেস্টুনও ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
স্বাধীনতার আগে থেকেই পুরান ঢাকার শাখাঁরিবাজারে ব্যবসা করে আসছেন পঙ্কজ কর্মকার।
তিনি জানালেন, বৈশাখের শুরুর দিন ভোরে দোকানপাট ধুঁয়ে, সোনা-রূপার পানি ও গোলাপ জল ছিটানো হয়। বকেয়া রয়েছে এমন ক্রেতাদের কাছে ইতোমধ্যে হালখাতার দাওয়াত কার্ড পাঠানো হয়েছে।
তিনি বলেন, সারা বছর জুড়ে কাস্টমারদের কাছে আমরা নানা জিনিসপত্র বিক্রি করি। অনেক সময় বাকিও থেকে যায়। তাই বছরের প্রথম দিনে আমাদের বকেয়া আদায় করে নতুন হিসাবের খাতা খুলতেই সাধারণত হালখাতা করে থাকি।
মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামল থেকে নতুন বছরের শুরুতে এ হালখাতার ব্যবহার শুরু হয় ভারতবর্ষে। পুরোনো হিসাব বন্ধ করে নতুন হিসাব খোলা হয় যে খাতায়, তাই হালখাতা নামে পরিচিত।
লাল কাপড়ে বাঁধাই করা মোটা এ খাতাটিই একসময় ক্রেতার সঙ্গে বিক্রেতার ব্যবসায়িক সম্পর্কের যোগসূত্র স্থাপন করতো। যা হাল আমলে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি পণ্য কম্পিউটারই করছে।
রাজধানীর মুগদার বাশার টাওয়ার সংলগ্ন মুদি দোকানী মা-মনি এন্টারপ্রাইজের সত্ত্বাধিকারী সারওয়ার আলম বাংলানিউজকে বলেন, সারা বছর ব্যবসা করি। ক্রেতাদের সঙ্গে নানা ঘটনা ঘটার মধ্য দিয়ে বেচা-বিক্রি চলে।
তাই নতুন বছরের শুরুতে তাদের নিমন্ত্রণ করে সম্পর্কটা আরও জোড়ালো করার চেষ্টা করা হয়। তবে এখন আগের মতো হালখাতার জৌলুশ নেই বলে জানান তিনি।
তার সঙ্গে সুর মেলারেন দক্ষিণ মান্ডা এলাকার প্রবাসী ও ক্রেতা রহমত উল্লাহও। তিনি বলেন, গত ১৪ বছর ধরে মা-মনি এন্টারপ্রাইজ থেকে নানা পণ্য কিনছি। দেশের বাইরে থাকায় পরিবারের সদস্যরা কোনো একটা দোকান থেকে নানা প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতেন। আর তা পহেলা বৈশাখের হালখাতায় পরিশোধ করতাম। কিন্তু এখন আগের মতো হালখাতা হয় না।
জানতে চাইলে তাঁতীবাজারের কাপড় ব্যবসায়ী হাজী আবদুল হাই চৌধুরী বলেন, আগে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে সম্পর্ক ছিল মধুর। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ক্রেতারা পাইকারী মালামাল কিনতে আসতেন। এমনকি সেই সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে ক্রেতাকে অনেক টাকার বাকিও দেওয়া হতো, যার হিসাব খাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখা হতো। এখন বাকির হিসেব খুব কমই হয়।
‘যান্ত্রিক’ মানুষের সেই মধুর সম্পর্কটাও নেই বলে মন্তব্য ষাটোর্ধ্ব এই ব্যবসায়ীর।
এদিকে বিক্রেতারা জানিয়েছেন, বর্তমানে প্রায় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই কম্পিউটার রয়েছে। খাতার কাজ এখন কম্পিউটারই করছে।
রাজধানীর চকবাজারের ব্যবসায়ী মো. গোলাম মোহাম্মদ বলেন, আগে বিভিন্ন পণ্য বিক্রির জন্য ক্রেতাদের হাতে লেখা টালি (স্লিপ) দেওয়া হতো। কিন্তু কম্পিউটারাইজড স্লিপ দেওয়া হয়। ফলে খাতা রাখার খুব একটা প্রয়োজন হয় না।
একই কথা জানালেন খাতা তৈরিকারেরাও। অনেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বাপ-দাদার পেশা পরিবর্তন করে নিত্য নতুন পেশা বদল করেছেন।
পুরান ঢাকার চকবাজারের বই খাতা ঘরের হাবিবুর রহমান বলেন, আগে বৈশাখ এলেই হালখাতাকে কেন্দ্র নতুন খাতা বিক্রির দুম লেগে থাকতো। কিন্তু এখন আগের মতো আর ব্যবসায়ীরা এ খাতা কেনেন না। আগে যেখানে একেকজন ব্যবসায়ী একবারে কয়েক মাসের খাতা কিনতেন এখন সেখানে এটা কমে এসেছে মাত্র পাঁচ-ছয়টিতে। ধীরে ধীরে এ প্রথাটি উঠেই যাচ্ছে।
জমিদারি আমলে ‘হালখাতা’বৈভবের চূড়ান্তে পৌঁছেছিল। বর্তমানে ডিজিটাল ঝাপটা সামলে হয়তো আরও কিছুদিন টিকে থাকবে বাংলা ভাষার অতিথি ‘হালখাতা’ (আরবি-ফারসি)।