প্রয়োজন গাড়ির আগে ঘোড়া…
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে পুরো ঢাকাকে ওয়াইফাই জোনে পরিণত করার একটা চেষ্টা করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল রাস্তায় বের হলেই লোকজন তাদের গেজেটে দ্রুত গতির ৩জি ইন্টারনেট সংযোগ পেয়ে যাবেন। কোন প্রকারের মডেম লাগবে না, কিন্তু, হলো কি? ওলো, বাংলা লায়ন’রা ওয়াইফাই কি মডেম দিয়েও গ্রাহকদের গ্রহণযোগ্য সেবা দিতে পারেনি!
সরকার পানির দামে অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে ডাটা আদান প্রদানের ব্যবস্থাকে গ্রামীণের কাছে লিজ দিল অথচ বিটিসিএল’কে ল্যাংড়া করে রাখল! সুনামগঞ্জে বিটিসিএল একচেঞ্জের ইঞ্জিনিয়ার নিজে জুম দিয়ে সেবা নেন, সেখানে সাধারণ নাগরিক দ্রুতগতির ব্রডব্যান্ড সংযোগ পাবে কিভাবে?
এখন শোনা যাচ্ছে সরকার হাটে, মাঠে, ঘাটে ওয়াইফাই হট-স্পট তৈরি করবেন! ভালো কথা, কিন্তু এইসব চালু করার প্রয়োজনীয় মেরুদণ্ড কি আমাদের দেশে (ঢাকা, চট্টগ্রাম বাদে) কোন কালে, কোন সরকার স্থাপন করার চেষ্টা করেছে? আমলা, মন্ত্রী আর তাদের দোসররা প্রতি মাসে লক্ষ-কোটি মিনিট বৈদেশিক কলের টাকা অবৈধ ভিওআইপি’র মাধ্যমে পকেটস্থ করছে কিন্তু দেশের অর্থ বিদেশে চলে যাবে এই অজুহাতে দ্রতগতির ইন্টারনেট সেবা চালু করছেনা পাছে গরিব লোকজন স্কাইপের মাধ্যমে বিদেশ থাকা শ্রমিক আত্মীয়ের সাথে বিনে পয়সায় কথা বলে ফেলে!
মনে পড়ে ১০ টাকা মিনিটের সময় বলা হয়েছিল পল্লী ফোনের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুরো পাল্টে ফেলার গল্প? অথচ ২০১৪ সালে ন্যায্য মুল্যের দাবিতে গ্রাম্য খামারিরা মহাসড়কে দুধ, শিম, পিয়াজ ফেলে ক্ষোভ জানাচ্ছে! এখানে তথ্য প্রযুক্তি নয় দরকার সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন, চাঁদাবাজমুক্ত মহাসড়ক। ৫০০ টাকা যখন একটা গড় পড়তা ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্য, ৬০ শতাংশ মানুষের দৈনিক আয় যখন মাত্র ১৬০ টাকা আর যাদের হাতে বিন্দু পরিমাণ জমা টাকা নাই তাদের এক ঝটকায় আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি সেবার আওতার ভিতর নিয়ে আসার চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
রাজধানীতে বাসে ওয়াইফাই রাউটার লাগানো থাকবে, ভালো উদ্যোগ, কিন্তু যাত্রীদের জন্য প্রয়োজনীয় বাস সেবা কি এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করা গেছে? ঢাকাবাসীর প্রথম প্রয়োজনটা কি? প্রতিদিন বাদুর ঝুলা হয়ে স্মার্ট ফোন টেপা নাকি আরামে বসে নিরাপত্তার সাথে অন্য প্রয়োজনীয় সেবা গ্রহন করা? বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো যাতায়াত ব্যবস্থার অধিকারী ব্রিটেনের কি অবস্থা? লন্ডনের বাসে, ট্রেনে কি ইন্টারনেটের ব্যবস্থা আছে? আমিত জানি টিউবেই এখনও ফোন সংযোগ কাজ করে না! প্যরিস আর নিউ ইয়র্কের কি অবস্থা?
আমাদের দেশে একজন টিপসই সর্বস্ব ব্যাক্তি কিভাবে আধুনিক প্রযুক্তি থেকে নিজের রুটি রুজির ব্যবস্থা করতে পারবে তা আমার বোধগম্য নয়! গ্রামীণ লোকজনকে তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে লাভবান করতে চাইলে আগে শিক্ষার আলো জ্বলাতে হবে, স্মার্ট ফোন আর কম দামে ভালো মানের গেজেট কেনার সামর্থ্যবান করে তুলতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে ওয়াইফাই সেবা নিয়ে যেতে চাইলে আগে সেখানে বিদ্যুৎ নিয়ে যেতে হবে। আমাদের দুর্ভাগ্য এখনও শত শত ইউনিয়ন খুঁজে পাওয়া যাবে যা বিদ্যুৎ সেবার আওতায় আসেনি!
উন্নত বিশ্বে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ ব্যবহিত হয় তথ্য প্রযুক্তি খাতে। তাই বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন ব্যতিত আইসিটি খাতের উন্নতি অসম্ভব। তাড়াহুড়ো করে নেয়া অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত লোড-শেডিং বাড়াবে, শিল্প কারখানা বন্ধ থাকবে। জেলা সদর হাসপাতালে এখনও খোঁজ নিলে দেখা যাবে প্রয়োজনীয় বিদ্যুত ব্যবস্থার অভাবে কত দামি বিদেশী যন্ত্রপাতি পড়ে আছে! আমাদের উচিত প্রায়োরিটি নির্ধারণ করা এবং যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয়া।
তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা উন্নত বিশ্ব থেকে অনেকটা পিছিয়ে আছি, কিন্তু, এখন এক লাফে তাদের ছুঁয়ে ফেলার চেষ্টা বুমেরাং হবে। পৃথিবীর সব সরকার কেনাকাটায় খুব উৎসাহী থাকে। এখন হুজুগ তুলে অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনাকাটা শুরু করলে দশের ক্ষতি, দেশের ক্ষতি। আমাদের উচিত ফাইবার অপটিকের বিস্তৃতির দিকে নজর দেয়া, নতুন সাবমেরিন লাইনে যুক্ত হওয়া, ইন্টারনেটের মূল্য নাগরিকদের ক্রয় ক্ষমতার ভিতর নিয়ে আসা। তবেই সকল নাগরিকদের তথ্য প্রযুক্তির সেবা নিশ্চিত করা যাবে। তথ্য এখন অধিকারে পরিণত হয়েছে আর সেই তথ্য সময় মত পেতে প্রয়োজন ন্যায্য মুল্যের তথ্য প্রযুক্তির সেবা। আর এটি নিশ্চিত করতে প্রয়োজন গাড়ির আগে ঘোড়া, ঘোড়ার আগে গাড়ি নয়।