সাংস্কৃতিক অশ্লীলতা এখন চরমে
সাংস্কৃতিক অশ্লীলতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আজ সিনেমায় নায়ক-নায়িকারা নগ্ন হয়ে রঙিন পর্দায় একে অন্যকে চুম্বন করতেও লজ্জাবোধ করছে না। কোনো কোনো নায়িকা যতটুক উলঙ্গ হয়েছে ততটুকুতে তৃপ্ত নয়, সে খুব জোর গলায় পত্রিকায় বলে যাচ্ছে- পরিচালক চাইলে আরো উলঙ্গ হতেও রাজি। আমাদের সমাজে আজ বেশ্যাবৃত্তি কোনো অপমানের বিষয় থাকছে না। পত্রিকাগুলোর ভাষা দেখলে মনে হয় সমাজকর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, রাজনৈতিককর্মী আর যৌনকর্মী এক-ই রকমের সম্মানজনক কাজ। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮/২ ধারায় বলা হয়েছে ‘গণিকাবৃত্তি ও জুয়া খেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ পরকীয়াও এখন আর কোনো বিষয় নয়, বিশেষ করে আকাশ পথে ভারতীয় নাটকগুলো তাই প্রচার করছে প্রতিদিন। পরকিয়া সংস্কৃতি, না অপসংস্কৃতি? এই প্রশ্নের উত্তরে কেউ যদি রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকে সামনে নিয়ে বলেন-‘কৃষ্ণ করলে লীলা খেলা আমি করলে দোষ’ কেনো? তখন উত্তরে বলতে হয় কৃষ্ণ আমাদের আদর্শ নয়।
শুদ্ধ এবং অশুদ্ধ সংস্কৃতির যুদ্ধে শুদ্ধের চর্চাটা বেশি হলে-ই অশুদ্ধ হারিয়ে যাবে শুদ্ধের আড়ালে। এই কথাকে আমরা যদি বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিচার করি তবে বলতে হবে- মানুষের নিউরনের উন্নতি যে দিকে বৃদ্ধি পায় মানুষ সেই দিকে-ই ধাবিত হয়। আমরা যদি প্রচার মাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আলোচনা ইত্যাদিতে শুদ্ধ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে পারি তা হলে অশুদ্ধ সংস্কৃতিগুলো এমনিতেই পালাবে।
এদেশের মুসলমানদের মধ্যে কে বা কারা একটা ভূল বিশ্বাস জন্মিয়ে দিয়েছে, বাঙালির সংস্কৃতির সাথে ইসলাম এবং মুসলমানদের সংঘাত রয়েছে। এটা যারা-ই করেছে তারা অবশ্য-ই ইসলামের বন্ধু নয়। ইসলামের সাথে অশুদ্ধ, অসত্য আর শিরক ছাড়া অন্য কিছুর সংঘাত নেই। বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিকে যারা ইসলামের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন তারা হয়তো ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ, নতুবা সচেতন শত্রু। তাদের জানা নেই, এই বাংলার সংস্কৃতিকে মুসলমানেরা ফুলে, ফলে, রূপে, গন্ধে সুসজ্জিত ও সুরভিত করেছে। মুসলমানেরা এটা একদিনে করেনি, করেছে হাজার বছরে। আবুল মনসুর আহমদ একটু অহমবোধ থেকে-ই বলছেন- "বাংলার মাটির সাথে আমাদের সম্পর্ক হাজার বছরেরও বেশি কালের। পুরা সাড়ে ছয়শ বছর আমরা এই দেশের শাসক ছিলাম। তার মধ্যে প্রায় তিন শ বছর আমরা স্বাধীন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা শাসন করেছি। এই মুদ্দতে আমরা বাংলাকে নিজস্ব জাতি-নাম, ভাষা ও সাহিত্য দিয়া ছিলাম। সে ভাষা ও সাহিত্যের মধ্য দিয়া বাঙ্গালীত্বকে নতুন মর্যাদা, তার ভাষায় নতুন সুর, তার গলায় নতুন জোর দিয়া ছিলাম। কৃষ্টি-সভ্যতা, শিল্প-বাণিজ্য ও শিক্ষা-সাহিত্যে সভ্য জগতের দরবারে বাংলাদেশকে করিয়া ছিলাম সুপ্রতিষ্ঠিত।’ (আমাদের কালচার, পৃ. ২৫, প্রকাশকাল:১৯৬৬)। আবুল মনসুর আহমদের সাংস্কৃতিক জ্ঞান ছিলো বলে-ই তাঁর ভেতরে অহমবোধ ছিলো। তিনি নিজেই বলেছেন- "‘সংস্কৃতি আমাদের সমবেত ব্যক্তিত্ব বা সামাজিক আমিত্ব।’ তিনি মনে করতেন "‘বাংলাভাষা ও সাহিত্যের পিতা মুসলমানেরা।’(প্রাগুক্ত, পৃ.২৬)। আবুল মনসুর আহমদের এই অহমবোধ ছিলো বলে-ই আজ আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বে বুক উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছি। আবুল মনসুর আহমদ যদি সেদিন ছয় দফা প্রণয়ন করে না দিতেন তবে এর ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু আন্দোলনের সূচনা করতে পারতেন না। ছয় দফার আন্দোলন না হলে একাত্তরে আমরা স্বাধীন হতে পারতাম না। আজ যে আমরা স্বাধীন তাতে সবচাইতে বড় ভূমিকা আবুল মনসুর আহমদের সাংস্কৃতিক অহমবোধ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার পর আমরা যেমন আবুল মনসুর আহমদ প্রমূখদের মতো সাংস্কৃতিক অহমবোধ সম্পন্ন চিন্তকদের মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি তেমনি আমরা জাতির মধ্যে তাদের মতো নতুন চিন্তক তৈরী করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। ফলে দিনে দিনে আমাদের জাতীয় প্রতিটি বিষয় অধঃপতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শুদ্ধ সংস্কৃতির মাধ্যমে আমরা যদি সামাজিক ‘আমিত্ব’ জাগাতে না পারি তবে আমাদের এই স্বাধীনতা মূল্যহীন থেকে-ই যাবে। এখনতো আর পরাশক্তি-আধিপত্যবাদীরা রাজ্য দখল করে মানুষকে শোষণ করে না, তারা এখন দখল করে মানুষের চিন্তা- চেতনা। মানুষ যখন সামাজিক আমিত্ব কিংবা অহমবোধ হারিয়ে ফেলে তখন সাম্রাজ্যবাদীদের বিলাসী অশুদ্ধ সংস্কৃতি কম্পিউটার ভাইরাসের মতো মানুষের মধ্যে প্রবেশ করে সকল চিন্তা-চেতনা লুপ্ত করে ফেলে। আমরা গোটা জাতি বর্তমানে এই পর্যায়ে-ই আছি।