“মিশরের পথে পথে” এক পর্যটকের কষ্টার্জিত অভিজ্ঞতার প্রয়াস
ঢাকার উৎস প্রকাশ থেকে প্রকাশিত সিলেটের পর্যটক মোহাম্মদ ইলিয়াস আলীর “মিশরের পথে পথে” শিরনামে বইটি তাঁর কষ্টার্জিত একটি ভ্রমণ বিবরণী গ্রন্থ । অমর একুশে বইমেলা ২০১৩ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত বইটির জন্য মিশরের পিরামিড, ছিটাডেল খাতেবী দূর্গ, নীল নদ প্রভৃতির বাস্তব ছবি সমন্বয়ে আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ এঁকেছেন সমর মজুমদার। ৬৫ গ্রাম অফসে কাগজে চেইন বাঁধাই করা ১২৫ টাকা মূল্যের ৮০ পৃষ্ঠা বইটি উৎসর্গ দেয়া হয়েছে নিঃস্বার্থ সমাজসেবক দানবীর আলহাজ্ব মোঃ বশির মিয়া’কে। বইটির মোড়কে ভ্রমণ বিবরণী এবং ইতিহাস নির্ভর একটি লেখা দিয়ে পর্যটকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরেছেন বহুমার্তিক লেখক ও গবেষক রব্বানী চৌধুরী। বইটির ভূমিকা লিখেছেন লেখক নিজেই। তিনি ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন বাস্তবে পিরামিড দেখার স্বপ্ন দেখতেন ছেলেবেলা থেকে। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর এ স্বপ্ন পূর্ণ করেছেন ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে; ইতোপূর্বে মধ্যযুগের সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম চীন দেশের প্রাচীর এবং আগ্রার তাজমহল দেখেছেন। ভ্রমণ কাহিনী সম্পর্কে কিছু লেখার ইচ্ছ তাঁর ছিল না; কিন্তু শুভানুধ্যায়ীদের তাগিদে লিখেছেন। যাদের উৎসাহে বইটি লিখেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- গবেষক প্রফেসর নন্দলাল শর্মা, বহুমাত্রিক লেখক রব্বানী চৌধুরী, গীতিকার হাসনাত মোহাম্মদ আনোয়ার, এ্যাভোকেট মণি গাঙ্গুলী, শিক্ষক মোঃ হেকিম উদ্দিন, গীতিকার মোঃ আছাব আলী এবং তাঁর সহধর্মিনী মোছাম্মৎ ছামিরুন বিবি। তাঁদের উৎসাহ না থাকলে আমরা সাধারন পাঠক সমাজ ঘরে বসে মিশর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতাম। যুক্তরাজ্য প্রবাসী এই পর্যটক মিশরে মাত্র সাত দিন অবস্থান করেছিলেন। এই অল্পদিনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান, প্রতœতত্ত্ব নিদর্শন পর্যবেক্ষণ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন আজ হতে হাজার হাজার বছর আগে আমাদের আদি সমাজ ব্যবস্থা, মানুষের জীবন চিত্র, তাঁদের চিন্তা চেতনা আর বীরত্বের অমর কীর্তি সম্পর্কে। সেই সাত দিনের ভ্রমণ কাহিনী লিপিবদ্ধ করে সফর সূচি অনুযায়ী প্রতিটি অধ্যায় সাজিয়েছেন। অধ্যায়গুলো এমন- প্রথম দিন, দ্বিতীয় দিন, তৃতীয় দিন, চতুর্থ দিন, পঞ্চম দিন, ষষ্ঠ দিন, সপ্তম দিন। এরপর পর্যবেক্ষণ করা প্রতিটি প্রতœনিদর্শন সম্পর্কে লিখিত প্রবন্ধের শিরেরনাম দিয়ে পৃষ্ঠাঙ্কন করেছেন। চৌদ্দ ফ্রন্টের গুরুত্বপূর্ণ এই বইটি অলঙ্করণের সময় পর্যাপ্ত মার্জিন রাখতে একটু কার্পণ্যতা দেখানো হয়েছেন বলেই প্রতিয়মান হয়। যে কোন বইয়ে পর্যাপ্ত মার্জিন থাকলে পৃষ্ঠা-সমূহ দেখতে ভাল লাগে। “মিশরের পথে পথে” বইটির মার্জিন আরেকটু বেশি রাখলে ভাল হতো। সে যাইহউক- পর্যটক মোহাম্মদ ইলিয়াস আলীর এই বইটি পড়লে পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য প্রতœনিদর্শন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা, এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন, অপরিচিত এলাকায় ভ্রমণের সময় সতর্কতা অবলম্বন ইত্যাদি বিষয়ে ধারনা ও সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। বইটি পড়লে মিশরিয়দের বর্তমান সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠান,
সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। এছাড়াও মিশরের কোন প্রতœনিদর্শন কিভাবে দেখতে হবে, সেখানে কিভাবে যেতে হবে, কোন সময় যেতে হবে, কোন প্রতœনিদর্শনের প্রবেশ ফি কত, পর্যটকদের আবাস ব্যবস্থা, মিশরের হোটেল সমূহের খাবার মান, যানবাহন ব্যবস্থাপনা, আইন শৃংখ্যলা পরিস্থিতি, ইত্যাদি সম্পর্কে যথেষ্ট ধারনা পাওয়া যায়। আমরা জানি- গ্রীক পর্যটক মেগাস্থিনিস, চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং, ফাহিয়েন, মা- হুয়ান, মরক্কীয় পরিব্রাজক ইবনে বতুতা প্রমুখ পর্যটকগণ ইতিহাসরে নিদর্শন আবিস্কার করে জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন। মোহাম্মদ ইলিয়াস আলী জগদ্বিখ্যাত হতে পারবেন না হয়ত; কিন্তু একজন পর্যটক হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য বলে আমি মনে করি। মিশরের ভ্রমণ কাহিনী বইটি অতি সহজ সাবলিল ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন বিধায় যে কেউ এর বিষয়বস্তু বুঝতে কোন সমস্যা হবে না। সিলেটের কালেক্টর রবার্ট লিন্ডসে রচিত “সিলেটে আমার বারো বছর” বইটি দীর্ঘদিন পরেও পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে; আমাদের সিলেটের কৃতিসন্তান মোহাম্মদ ইলিয়াস আলীর “মিশরের পথে পথে” বইটিও একদিন রবার্ট লিন্ডসের “সিলেটে আমার বারো বছর” বইটির মতো পাঠদের বিশেষ প্রয়োজন হতে পারে। ইতিহাস সচেতন এই পর্যটক বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রতœনিদর্শন পর্যবেক্ষণ করে ইবনে বতুতা কিংবা হিউয়েন সাংদের সাথে তালিকায় না গেলেও ভ্রমন বিবরনী লেখার দিক থেকে তিনি রবার্ট লিন্ডসের কাতারে একদিন আসবেন আমার বিশ্বাষ।
মিশর ভ্রমণ করে মোহাম্মদ ইলিয়াস আলী শুধু নিজেই উপভোগ করেননি; বরং তাঁর ভ্রমণ বিবরনী গ্রন্থগত করে সাধারন মানুষকে মিশর ভ্রমনের আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। তাঁর লেখা এমনভাবে অলংকরন করেছেন যা পড়লে মিশর ভ্রমন না করেও মিশর সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা অর্জনে কোন ত্রুটি থাকবে না। মোহাম্মদ ইলিয়াস আলী তাঁর জীবনে সাত দিনের মিশর ভ্রমনে যে ঐতিহাসিক প্রতœনিদর্শন দেখেছেন সেগুলো হচ্ছে- প্রাচীন মিশরের তৃতীয় রাজ বংশের ফেরা রাজা জোসেফের শাসনামলের নিদর্শন, প্রাচীন মিশরের চতুর্থ রাজবংশের ফেরা রাজা মেনকাউয়ারা নির্মিত পিরামিড, ফেরা রাজা খাফরে নির্মিত পিরামিড, ফেরা রাজা খুফু কর্তৃক নির্মিত মহা পিরামিড, পৃথিবীর বৃহত্তম ও প্রাচীন মুর্তি স্ফিংস, মিশরের মামলুক সুলতান খানসুর আল গহরী কর্তৃক নির্মিত আল গহরী মসজিদ, শিয়া সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় মসজিদ আল হোসাইন, ৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত মিশর শাসনামলের আজহবর মসজিদ, কায়রো জাদুঘর, কায়রো জাদঘুরে রক্ষিত প্রাচীন মিশরীয়দের বায়ুর দেবতা “আমুন” মুর্তি, জগতের দেবতা “আনুবিস” মুর্তি, সূর্যদেবতা “রা” বা “হোরাম” মুর্তি, প্রাচীন দেবতা সেট এর স্ত্রী “নেপথিস” এর মুর্তি, দেবী “নেপথিস” এর মুর্তি, মিশরের লুক্স শহরে অবস্থিত মিশরীয় ফেরাউন রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে কম-বয়সী রাজা তুতেনখামেনের জাদুঘর; যেখানে তুতেনখামেন জীবিতকালীন সময়ে ব্যবহৃত সর্বমোট ৫৩৯৮টি জিনিস সংরক্ষিত আছেন, রাজার সমাধি, রাজা তুতেনখামেনের ধনসম্পদ যেমন- আসবাবপত্র, স্বর্ণের অলংকার, স্বর্ণের সিংহাসন,
স্বর্ণের পালংক, মৃত্যুর পর রাজার মরদেহ গোসল কারানোর পালংক, মরদেহের কফিন, মমির মাথার মুকুট ইত্যাদি । আরো দেখেছেন- প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার আইটেম সংরক্ষন করা কায়রো জাদুঘর; যেখানে সংরক্ষিত ৪০০০/৫০০০ বছর আগের প্রাচীন মিশরীয় রাজকুমারী/রাজরানীদের স্বর্ণের অলংকার, ৩৮০০ বছরের পুরনো নৌকা, পাথরের তৈরী প্রাচীন রাজবাড়ির গেইট, পাথরের তৈরী রাজ রানীদের মুুর্ত্তি। দেখেছেন রামাসিস দ্বিতীয় বা ফেরাউনের মমি। এছারাও আলেকজান্দ্রিয়ায় সংরক্ষিত শিরের সুলতান আল আশরাফে আল দ্বীন খাতবী নির্মিত মনোরম ইমারত ছিটাডেল খাতেবী দূর্গ। মিশরের সুলতান কর্তৃক ১৭৭৫ সালে নির্মিত মসজিদ, ১.৫০ মিলিয়ন বই সংরক্ষিত আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত লাইব্রেরী,। সাক্কারা পিরামিড “খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৩০-২৬১১ অব্দে” নির্মিত, প্রাচীন মিশরে ৫/৭ হাজার বছরের পুরনো দালানের খুটি, ফেরা রাজার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পিলার, এপিসের সমাধি, গির্জার বিখ্যাত পিরামিড, গির্জার তৃতীয় বৃহত্তর পিরামিড। ১১৭৬-১১৮৩ সালে মিশরের শাসনকর্তা সুলতান সালাদ্বীন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সালাদ্বীন ছিটাডেল দূর্গ, আধুনিক মিশরের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী পাশা কর্তৃক নির্মিত মোহাম্মদ আলী মসজিদ, মিশরের শাসনকর্তা কর্তৃক ১৩১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজকীয় আল নাসের মোহাম্মদ মসজিদ। ১৫২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত সুলেমান পাশা মসজিদ, আল গওহরি ভবন বা জাদুঘর, খোলা বাগান জাদুঘর, রিয়েল কারেজ জাদুঘর, ইউসুফ নদী, নীল নদ, মিশরে অবস্থিত কারুনের নগরী, ১৩২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত খান আল খালেলী বাজার ইত্যাদ। মাত্র সাত দিনে মোহাম্মদ আলিয়াস আলীর এই বিশাল সফর যে কাউকে ভাবিয়ে তুলবে। শারিরীক পরিশ্রম অর্থ ব্যয় সময়ের অপচয় কোন কিছু না ভেবে বিশ্বের বিখ্যাত প্রতœনিদর্শন পর্যবেক্ষণ করে প্রমান করলেন তিনি একজন ইতিহাস সচেতন মানুষ। তিনি মিশর ভ্রমন করে কি যে এক অনন্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন এই বইটি না পড়লে তা অজানাই থেকে যেতো। “মিশরের পথে পথে” ভ্রমণ বিবরনী বইটি পড়লে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা সম্পর্কে এক অসাধারন অভিজ্ঞতা অর্জন হবে। পর্যটক বিভিন্ন প্রতœনিদর্শন দেখার বর্ণনা ও অভিজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি প্রতœনিদর্শন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা, বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাবলী, প্রতœনিদর্শনের পিছনে লুকিয়ে থাকা লোককথা, বিভিন্ন সময়ের রাজাদের নাম, রাজত্বকাল, রাজার জন্ম পরিচয়, প্রতœনিদর্শন আবিষ্কারকের নাম ও পরিচয়, প্রতœনিদর্শন আবিষ্কারের সংক্ষিপ্ত কাহিনী, প্রতœ নিদর্শনের বর্তমান অবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রাচীন ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ইত্যাদি অত্যান্ত গুরুত্বদিয়ে লিখেছেন। মিশর ভ্রমণের কাহিনী নিপুন ভাবে লিখতে গিয়ে বর্ণনা দিয়েছেন – পিরামিড কী, পিরামিড কিভাবে তৈরী হয়, পিরামিড তৈরীর পাথরের উৎস, পিরামিডের আকৃতি গঠন প্রণালী, পৃথিবীর বৃহত্তম ও প্রাচীন মুর্তি ষ্পিংস মুর্ত্তির গঠন প্রণালি আয়তন সংক্ষিপ্ত বর্ণনা স্ফিংসের মুর্তি সম্পর্কে মিশরে প্রচলিত লোককাহিনী। প্রাচীন কালে মিশর শাসন করতেন কারা, তাঁদের উপাধি কী ছিল। মিশরের চিত্রলিপি হায়ারোগ্লিফিক ও ভাষা সম্পর্কে আলোচনা, হায়ারোগ্লিফিক শব্দের অর্থ, লিপির জন্মস্থান, চিত্রলিপি আবিষ্কারকের নাম, হায়ারোগ্লিফিক লিপির
বিবর্তিত নাম সময়কাল বিলুপ্তির সময়। যুগপরস্পরায় মিশরে আরবি ভাষা ও বর্ণমালা প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। মিশর ফরাসিদের শাসনাধীন হওয়ার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা, কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন মিশরীয় লিপি পুনঃআবিষ্কারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, রেনেসা পাথর বৃটিশ মিউজিয়ামে যাওয়ার কাহিনী, প্রাচীন কালের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা এবং বিশ্ববিখ্যাত বীর আলেকজান্ডার সম্পার্কে বিশেষ আলোচনা করে বইটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন। সেই ফাঁকে মিশরীয়দের বিয়ের বর্তমান আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কে সাম্যক ধারনা দিয়ে গেছেন। তাঁর এই সুনিপুণ বর্ণনা “মিশরের পথে পথে” বইটি পাঠে সাধারন পাঠকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও উপকৃত হবেন। মোহাম্মদ ইলিয়াস আলীর মিশর ভ্রমনের সময় গুরুত্বপূর্ণ কিছু বই সংগ্রহ করেছেন। তাঁর এই সংগ্রহকে দূর্লভ বলেই স্বীকার করতে হয়। কারন ইচ্ছে করলেই এই বইগুলো সংগ্রহ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি মিশরের প্রতœনিদর্শন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে গিয়ে বেশ কিছু আলোকচিত্র সংগ্রহ করেছেন। সংগৃহীত আলোকচিত্র থেকে- ২৪টি গুরুত্বপূর্ণ ছবি বইয়ের পাতায় সংযোজন করেছেন। এতে বইটি আকর্ষণীয় হয়েছে, মূল্যায়নও বৃদ্ধি পেয়েছে। “মিশরে পথে পথে” বইটিতে যে ছবি ছাপা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- পৃথিবীর প্রথম পিরামিড সাক্কারা-জোসেসের পিরামিডের ছবি, গির্জার পিরামিডের ছবি, স্ফিংস মুর্তির ছবি, আল গহরী মসজিদ, তুতেনখামেনের স্বর্ণের মুকুট ও কফিনের ছবি, রামেসিস দ্বিতীয় বা ফেরাউনের মমির ছবি, জেরা রাজা খুফুর মুর্তির ছবি, ছিটাডেল খাতেবী দূর্গের ছবি, মোহাম্মদ আলী মসজিদের ভিতরের কারুকার্যের ছবি, কারুনের বাড়ি, ফাইয়ুম পানির চাকার ছবি ইত্যাদি। মোহাম্মদ ইলিয়াস আলী মিশর ভ্রমণ কালে যারা তাঁর সফর সঙ্গী ছিলেন তাঁদের নাম উল্লেখ করেছন- আজাদ মিয়া এবং বশির ভাই। কিন্তু এই আজাদ মিয়া এবং বশির ভাই কে ? সেই পরিচয় বইটির কোথাও উল্লেখ করেছেন বলে চোখে পড়েনি। বিধায় তাঁদের পরিচয় সাধারন পাঠকের অজানাই থেকে গেলো। মোহাম্মদ ইলিয়াস আলী মিশর ভ্রমণ করতে গিয়ে তেমন কোন বিপাকে পরতে হয়নি; কায়রো এয়ারপোর্টে অবতরন করেই যে গাড়ি ভারা করেছিলেন সেই গাড়ির চালক ছিল “মাঝদিক” নামে এক মিশরীয় লোক। মাঝদিক তাঁদের বিশ্বস্থতা অর্জন করতে স্বক্ষম হয়েছিল। বিধায় মিশর ভ্রমণ সমাপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ব্যক্তি পর্যটকদের সফর সঙ্গী ছিলেন। মাঝদিক তাঁর দায়িত্ব সততা ও বিশ্বস্ততার সাথে পালন করেছিলেন বিধায় লেখক তাঁর লেখায় মাঝাদিকের নামটি বারবার উল্লেখ করেছেন। যাইহোক- ইলিয়াস আলী সাহেবের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকলেও তাঁর লেখনির সাথে দীর্ঘদিনের পরিচয়। ইতিহাস চর্চায় নিবেদিত প্রাণ মোহাম্মদ ইলিয়াস আলী একাধারে গীতিকার, লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক। এ পর্যন্ত তার ছয়টি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলো হচ্ছে- দেওয়ান একলিমুর রাজা : জীবন ও কাব্য, বিশ্বনাথের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, মনের আগুন কেউ না দেখে, ভাটির দেশে গানের রাজা, লোকসঙ্গীতের প্রবাদপুরুষ মুস্তাফা জামান আব্বাসী, মিশরের পথে পথে। তাছাড়া তাঁর সম্পাদনায় মাসিক সিলেট দর্পন এবং বার্ষিক বীথিকা নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। উল্লেখিত বইগুলোর মধ্যে
“মিশরের পাথে পথে” বইটি এ পর্যটকের কষ্টার্জিত অভিজ্ঞতার প্রয়াস। আমি আশাকরি তাঁর এই প্রয়াসটির উপযূক্ত মূল্যায়ন করা হবে।
“মিশরের পথে পথে” এক পর্যটকের কষ্টার্জিত অভিজ্ঞতার প্রয়াস
ফারুকুর রহমান চৌধুরী
ঢাকার উৎস প্রকাশ থেকে প্রকাশিত সিলেটের পর্যটক মোহাম্মদ ইলিয়াস আলীর “মিশরের পথে পথে” শিরনামে বইটি তাঁর কষ্টার্জিত একটি ভ্রমণ বিবরণী গ্রন্থ । অমর একুশে বইমেলা ২০১৩ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত বইটির জন্য মিশরের পিরামিড, ছিটাডেল খাতেবী দূর্গ, নীল নদ প্রভৃতির বাস্তব ছবি সমন্বয়ে আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ এঁকেছেন সমর মজুমদার। ৬৫ গ্রাম অফসে কাগজে চেইন বাঁধাই করা ১২৫ টাকা মূল্যের ৮০ পৃষ্ঠা বইটি উৎসর্গ দেয়া হয়েছে নিঃস্বার্থ সমাজসেবক দানবীর আলহাজ্ব মোঃ বশির মিয়া’কে। বইটির মোড়কে ভ্রমণ বিবরণী এবং ইতিহাস নির্ভর একটি লেখা দিয়ে পর্যটকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরেছেন বহুমার্তিক লেখক ও গবেষক রব্বানী চৌধুরী। বইটির ভূমিকা লিখেছেন লেখক নিজেই। তিনি ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন বাস্তবে পিরামিড দেখার স্বপ্ন দেখতেন ছেলেবেলা থেকে। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর এ স্বপ্ন পূর্ণ করেছেন ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে; ইতোপূর্বে মধ্যযুগের সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম চীন দেশের প্রাচীর এবং আগ্রার তাজমহল দেখেছেন। ভ্রমণ কাহিনী সম্পর্কে কিছু লেখার ইচ্ছ তাঁর ছিল না; কিন্তু শুভানুধ্যায়ীদের তাগিদে লিখেছেন। যাদের উৎসাহে বইটি লিখেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- গবেষক প্রফেসর নন্দলাল শর্মা, বহুমাত্রিক লেখক রব্বানী চৌধুরী, গীতিকার হাসনাত মোহাম্মদ আনোয়ার, এ্যাভোকেট মণি গাঙ্গুলী, শিক্ষক মোঃ হেকিম উদ্দিন, গীতিকার মোঃ আছাব আলী এবং তাঁর সহধর্মিনী মোছাম্মৎ ছামিরুন বিবি। তাঁদের উৎসাহ না থাকলে আমরা সাধারন পাঠক সমাজ ঘরে বসে মিশর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতাম। যুক্তরাজ্য প্রবাসী এই পর্যটক মিশরে মাত্র সাত দিন অবস্থান করেছিলেন। এই অল্পদিনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান, প্রতœতত্ত্ব নিদর্শন পর্যবেক্ষণ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন আজ হতে হাজার হাজার বছর আগে আমাদের আদি সমাজ ব্যবস্থা, মানুষের জীবন চিত্র, তাঁদের চিন্তা চেতনা আর বীরত্বের অমর কীর্তি সম্পর্কে। সেই সাত দিনের ভ্রমণ কাহিনী লিপিবদ্ধ করে সফর সূচি অনুযায়ী প্রতিটি অধ্যায় সাজিয়েছেন। অধ্যায়গুলো এমন- প্রথম দিন, দ্বিতীয় দিন, তৃতীয় দিন, চতুর্থ দিন, পঞ্চম দিন, ষষ্ঠ দিন, সপ্তম দিন। এরপর পর্যবেক্ষণ করা প্রতিটি প্রতœনিদর্শন সম্পর্কে লিখিত প্রবন্ধের শিরেরনাম দিয়ে পৃষ্ঠাঙ্কন করেছেন। চৌদ্দ ফ্রন্টের গুরুত্বপূর্ণ এই বইটি অলঙ্করণের সময় পর্যাপ্ত মার্জিন রাখতে একটু কার্পণ্যতা দেখানো হয়েছেন বলেই প্রতিয়মান হয়। যে কোন বইয়ে পর্যাপ্ত মার্জিন থাকলে পৃষ্ঠা-সমূহ দেখতে ভাল লাগে। “মিশরের পথে পথে” বইটির মার্জিন আরেকটু বেশি রাখলে ভাল হতো। সে যাইহউক- পর্যটক মোহাম্মদ ইলিয়াস আলীর এই বইটি পড়লে পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য প্রতœনিদর্শন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা, এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন, অপরিচিত এলাকায় ভ্রমণের সময় সতর্কতা অবলম্বন ইত্যাদি বিষয়ে ধারনা ও সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। বইটি পড়লে মিশরিয়দের বর্তমান সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠান,
সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। এছাড়াও মিশরের কোন প্রতœনিদর্শন কিভাবে দেখতে হবে, সেখানে কিভাবে যেতে হবে, কোন সময় যেতে হবে, কোন প্রতœনিদর্শনের প্রবেশ ফি কত, পর্যটকদের আবাস ব্যবস্থা, মিশরের হোটেল সমূহের খাবার মান, যানবাহন ব্যবস্থাপনা, আইন শৃংখ্যলা পরিস্থিতি, ইত্যাদি সম্পর্কে যথেষ্ট ধারনা পাওয়া যায়। আমরা জানি- গ্রীক পর্যটক মেগাস্থিনিস, চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং, ফাহিয়েন, মা- হুয়ান, মরক্কীয় পরিব্রাজক ইবনে বতুতা প্রমুখ পর্যটকগণ ইতিহাসরে নিদর্শন আবিস্কার করে জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন। মোহাম্মদ ইলিয়াস আলী জগদ্বিখ্যাত হতে পারবেন না হয়ত; কিন্তু একজন পর্যটক হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য বলে আমি মনে করি। মিশরের ভ্রমণ কাহিনী বইটি অতি সহজ সাবলিল ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন বিধায় যে কেউ এর বিষয়বস্তু বুঝতে কোন সমস্যা হবে না। সিলেটের কালেক্টর রবার্ট লিন্ডসে রচিত “সিলেটে আমার বারো বছর” বইটি দীর্ঘদিন পরেও পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে; আমাদের সিলেটের কৃতিসন্তান মোহাম্মদ ইলিয়াস আলীর “মিশরের পথে পথে” বইটিও একদিন রবার্ট লিন্ডসের “সিলেটে আমার বারো বছর” বইটির মতো পাঠদের বিশেষ প্রয়োজন হতে পারে। ইতিহাস সচেতন এই পর্যটক বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রতœনিদর্শন পর্যবেক্ষণ করে ইবনে বতুতা কিংবা হিউয়েন সাংদের সাথে তালিকায় না গেলেও ভ্রমন বিবরনী লেখার দিক থেকে তিনি রবার্ট লিন্ডসের কাতারে একদিন আসবেন আমার বিশ্বাষ।
মিশর ভ্রমণ করে মোহাম্মদ ইলিয়াস আলী শুধু নিজেই উপভোগ করেননি; বরং তাঁর ভ্রমণ বিবরনী গ্রন্থগত করে সাধারন মানুষকে মিশর ভ্রমনের আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। তাঁর লেখা এমনভাবে অলংকরন করেছেন যা পড়লে মিশর ভ্রমন না করেও মিশর সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা অর্জনে কোন ত্রুটি থাকবে না। মোহাম্মদ ইলিয়াস আলী তাঁর জীবনে সাত দিনের মিশর ভ্রমনে যে ঐতিহাসিক প্রতœনিদর্শন দেখেছেন সেগুলো হচ্ছে- প্রাচীন মিশরের তৃতীয় রাজ বংশের ফেরা রাজা জোসেফের শাসনামলের নিদর্শন, প্রাচীন মিশরের চতুর্থ রাজবংশের ফেরা রাজা মেনকাউয়ারা নির্মিত পিরামিড, ফেরা রাজা খাফরে নির্মিত পিরামিড, ফেরা রাজা খুফু কর্তৃক নির্মিত মহা পিরামিড, পৃথিবীর বৃহত্তম ও প্রাচীন মুর্তি স্ফিংস, মিশরের মামলুক সুলতান খানসুর আল গহরী কর্তৃক নির্মিত আল গহরী মসজিদ, শিয়া সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় মসজিদ আল হোসাইন, ৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত মিশর শাসনামলের আজহবর মসজিদ, কায়রো জাদুঘর, কায়রো জাদঘুরে রক্ষিত প্রাচীন মিশরীয়দের বায়ুর দেবতা “আমুন” মুর্তি, জগতের দেবতা “আনুবিস” মুর্তি, সূর্যদেবতা “রা” বা “হোরাম” মুর্তি, প্রাচীন দেবতা সেট এর স্ত্রী “নেপথিস” এর মুর্তি, দেবী “নেপথিস” এর মুর্তি, মিশরের লুক্স শহরে অবস্থিত মিশরীয় ফেরাউন রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে কম-বয়সী রাজা তুতেনখামেনের জাদুঘর; যেখানে তুতেনখামেন জীবিতকালীন সময়ে ব্যবহৃত সর্বমোট ৫৩৯৮টি জিনিস সংরক্ষিত আছেন, রাজার সমাধি, রাজা তুতেনখামেনের ধনসম্পদ যেমন- আসবাবপত্র, স্বর্ণের অলংকার, স্বর্ণের সিংহাসন,
স্বর্ণের পালংক, মৃত্যুর পর রাজার মরদেহ গোসল কারানোর পালংক, মরদেহের কফিন, মমির মাথার মুকুট ইত্যাদি । আরো দেখেছেন- প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার আইটেম সংরক্ষন করা কায়রো জাদুঘর; যেখানে সংরক্ষিত ৪০০০/৫০০০ বছর আগের প্রাচীন মিশরীয় রাজকুমারী/রাজরানীদের স্বর্ণের অলংকার, ৩৮০০ বছরের পুরনো নৌকা, পাথরের তৈরী প্রাচীন রাজবাড়ির গেইট, পাথরের তৈরী রাজ রানীদের মুুর্ত্তি। দেখেছেন রামাসিস দ্বিতীয় বা ফেরাউনের মমি। এছারাও আলেকজান্দ্রিয়ায় সংরক্ষিত শিরের সুলতান আল আশরাফে আল দ্বীন খাতবী নির্মিত মনোরম ইমারত ছিটাডেল খাতেবী দূর্গ। মিশরের সুলতান কর্তৃক ১৭৭৫ সালে নির্মিত মসজিদ, ১.৫০ মিলিয়ন বই সংরক্ষিত আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত লাইব্রেরী,। সাক্কারা পিরামিড “খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৩০-২৬১১ অব্দে” নির্মিত, প্রাচীন মিশরে ৫/৭ হাজার বছরের পুরনো দালানের খুটি, ফেরা রাজার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পিলার, এপিসের সমাধি, গির্জার বিখ্যাত পিরামিড, গির্জার তৃতীয় বৃহত্তর পিরামিড। ১১৭৬-১১৮৩ সালে মিশরের শাসনকর্তা সুলতান সালাদ্বীন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সালাদ্বীন ছিটাডেল দূর্গ, আধুনিক মিশরের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী পাশা কর্তৃক নির্মিত মোহাম্মদ আলী মসজিদ, মিশরের শাসনকর্তা কর্তৃক ১৩১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজকীয় আল নাসের মোহাম্মদ মসজিদ। ১৫২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত সুলেমান পাশা মসজিদ, আল গওহরি ভবন বা জাদুঘর, খোলা বাগান জাদুঘর, রিয়েল কারেজ জাদুঘর, ইউসুফ নদী, নীল নদ, মিশরে অবস্থিত কারুনের নগরী, ১৩২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত খান আল খালেলী বাজার ইত্যাদ। মাত্র সাত দিনে মোহাম্মদ আলিয়াস আলীর এই বিশাল সফর যে কাউকে ভাবিয়ে তুলবে। শারিরীক পরিশ্রম অর্থ ব্যয় সময়ের অপচয় কোন কিছু না ভেবে বিশ্বের বিখ্যাত প্রতœনিদর্শন পর্যবেক্ষণ করে প্রমান করলেন তিনি একজন ইতিহাস সচেতন মানুষ। তিনি মিশর ভ্রমন করে কি যে এক অনন্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন এই বইটি না পড়লে তা অজানাই থেকে যেতো। “মিশরের পথে পথে” ভ্রমণ বিবরনী বইটি পড়লে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা সম্পর্কে এক অসাধারন অভিজ্ঞতা অর্জন হবে। পর্যটক বিভিন্ন প্রতœনিদর্শন দেখার বর্ণনা ও অভিজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি প্রতœনিদর্শন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা, বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাবলী, প্রতœনিদর্শনের পিছনে লুকিয়ে থাকা লোককথা, বিভিন্ন সময়ের রাজাদের নাম, রাজত্বকাল, রাজার জন্ম পরিচয়, প্রতœনিদর্শন আবিষ্কারকের নাম ও পরিচয়, প্রতœনিদর্শন আবিষ্কারের সংক্ষিপ্ত কাহিনী, প্রতœ নিদর্শনের বর্তমান অবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রাচীন ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ইত্যাদি অত্যান্ত গুরুত্বদিয়ে লিখেছেন। মিশর ভ্রমণের কাহিনী নিপুন ভাবে লিখতে গিয়ে বর্ণনা দিয়েছেন – পিরামিড কী, পিরামিড কিভাবে তৈরী হয়, পিরামিড তৈরীর পাথরের উৎস, পিরামিডের আকৃতি গঠন প্রণালী, পৃথিবীর বৃহত্তম ও প্রাচীন মুর্তি ষ্পিংস মুর্ত্তির গঠন প্রণালি আয়তন সংক্ষিপ্ত বর্ণনা স্ফিংসের মুর্তি সম্পর্কে মিশরে প্রচলিত লোককাহিনী। প্রাচীন কালে মিশর শাসন করতেন কারা, তাঁদের উপাধি কী ছিল। মিশরের চিত্রলিপি হায়ারোগ্লিফিক ও ভাষা সম্পর্কে আলোচনা, হায়ারোগ্লিফিক শব্দের অর্থ, লিপির জন্মস্থান, চিত্রলিপি আবিষ্কারকের নাম, হায়ারোগ্লিফিক লিপির
বিবর্তিত নাম সময়কাল বিলুপ্তির সময়। যুগপরস্পরায় মিশরে আরবি ভাষা ও বর্ণমালা প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। মিশর ফরাসিদের শাসনাধীন হওয়ার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা, কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন মিশরীয় লিপি পুনঃআবিষ্কারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, রেনেসা পাথর বৃটিশ মিউজিয়ামে যাওয়ার কাহিনী, প্রাচীন কালের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা এবং বিশ্ববিখ্যাত বীর আলেকজান্ডার সম্পার্কে বিশেষ আলোচনা করে বইটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন। সেই ফাঁকে মিশরীয়দের বিয়ের বর্তমান আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কে সাম্যক ধারনা দিয়ে গেছেন। তাঁর এই সুনিপুণ বর্ণনা “মিশরের পথে পথে” বইটি পাঠে সাধারন পাঠকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও উপকৃত হবেন। মোহাম্মদ ইলিয়াস আলীর মিশর ভ্রমনের সময় গুরুত্বপূর্ণ কিছু বই সংগ্রহ করেছেন। তাঁর এই সংগ্রহকে দূর্লভ বলেই স্বীকার করতে হয়। কারন ইচ্ছে করলেই এই বইগুলো সংগ্রহ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি মিশরের প্রতœনিদর্শন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে গিয়ে বেশ কিছু আলোকচিত্র সংগ্রহ করেছেন। সংগৃহীত আলোকচিত্র থেকে- ২৪টি গুরুত্বপূর্ণ ছবি বইয়ের পাতায় সংযোজন করেছেন। এতে বইটি আকর্ষণীয় হয়েছে, মূল্যায়নও বৃদ্ধি পেয়েছে। “মিশরে পথে পথে” বইটিতে যে ছবি ছাপা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- পৃথিবীর প্রথম পিরামিড সাক্কারা-জোসেসের পিরামিডের ছবি, গির্জার পিরামিডের ছবি, স্ফিংস মুর্তির ছবি, আল গহরী মসজিদ, তুতেনখামেনের স্বর্ণের মুকুট ও কফিনের ছবি, রামেসিস দ্বিতীয় বা ফেরাউনের মমির ছবি, জেরা রাজা খুফুর মুর্তির ছবি, ছিটাডেল খাতেবী দূর্গের ছবি, মোহাম্মদ আলী মসজিদের ভিতরের কারুকার্যের ছবি, কারুনের বাড়ি, ফাইয়ুম পানির চাকার ছবি ইত্যাদি। মোহাম্মদ ইলিয়াস আলী মিশর ভ্রমণ কালে যারা তাঁর সফর সঙ্গী ছিলেন তাঁদের নাম উল্লেখ করেছন- আজাদ মিয়া এবং বশির ভাই। কিন্তু এই আজাদ মিয়া এবং বশির ভাই কে ? সেই পরিচয় বইটির কোথাও উল্লেখ করেছেন বলে চোখে পড়েনি। বিধায় তাঁদের পরিচয় সাধারন পাঠকের অজানাই থেকে গেলো। মোহাম্মদ ইলিয়াস আলী মিশর ভ্রমণ করতে গিয়ে তেমন কোন বিপাকে পরতে হয়নি; কায়রো এয়ারপোর্টে অবতরন করেই যে গাড়ি ভারা করেছিলেন সেই গাড়ির চালক ছিল “মাঝদিক” নামে এক মিশরীয় লোক। মাঝদিক তাঁদের বিশ্বস্থতা অর্জন করতে স্বক্ষম হয়েছিল। বিধায় মিশর ভ্রমণ সমাপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ব্যক্তি পর্যটকদের সফর সঙ্গী ছিলেন। মাঝদিক তাঁর দায়িত্ব সততা ও বিশ্বস্ততার সাথে পালন করেছিলেন বিধায় লেখক তাঁর লেখায় মাঝাদিকের নামটি বারবার উল্লেখ করেছেন। যাইহোক- ইলিয়াস আলী সাহেবের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকলেও তাঁর লেখনির সাথে দীর্ঘদিনের পরিচয়। ইতিহাস চর্চায় নিবেদিত প্রাণ মোহাম্মদ ইলিয়াস আলী একাধারে গীতিকার, লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক। এ পর্যন্ত তার ছয়টি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলো হচ্ছে- দেওয়ান একলিমুর রাজা : জীবন ও কাব্য, বিশ্বনাথের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, মনের আগুন কেউ না দেখে, ভাটির দেশে গানের রাজা, লোকসঙ্গীতের প্রবাদপুরুষ মুস্তাফা জামান আব্বাসী, মিশরের পথে পথে। তাছাড়া তাঁর সম্পাদনায় মাসিক সিলেট দর্পন এবং বার্ষিক বীথিকা নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। উল্লেখিত বইগুলোর মধ্যে
“মিশরের পাথে পথে” বইটি এ পর্যটকের কষ্টার্জিত অভিজ্ঞতার প্রয়াস। আমি আশাকরি তাঁর এই প্রয়াসটির উপযূক্ত মূল্যায়ন করা হবে।
× × × খোলামত কলামে ছাপা হওয়া লেখা সম্পূর্ণ লেখকের মতামত এর জন্য সম্পাদক দায়ী নয় ।