একজন মুক্তিযোদ্ধার শেষ ইচ্ছা

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ কমান্ডার। বয়স প্রায় শ’য়ের কাছাকাছি। বাস করছেন সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জের সাচনা বাজার ইউনিয়নের ফাজিলপুর গ্রামের একচালা ঘরের নিজ বাড়িতে।

সাংবাদিক বন্ধু আকবর হোসেনের তথ্য মতে জানা যায় বয়সের ভারে ক্লান্ত আব্দুল লতিফের শেষ দুটি ইচ্ছার কথা। তার প্রথম ইচ্ছাটা হল তার তৈরী করা মা বাবা ও স্ত্রীর কবরের পাশে যেন তাকে কবর দেয়া হয়। আর দ্বিতীয় ইচ্ছাটা হল জামালগঞ্জে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের যাতে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়।

একজন মুক্তিযোদ্ধা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তারা জীবনকে বাজি রেখে দেশকে পরাধীনতার শৃংঙ্খল থেকে মুক্ত করে বিশ্বের বুকে লাল সবুজের মানচিত্র এঁকে দিয়েছেন। তাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়েই আমাদের অর্জিত এই স্বাধীনতা। যারা দেশকে মুক্ত করার জন্যে অস্ত্র ধরেছিলেন জাতি তাদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান করবে এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু, প্রশ্ন হল স্বাধীনতার দীর্ঘ দিন পরেও এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন হয়নি। সুযোগ নিয়ে অনেক অমুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তালিকাবদ্ধ হচ্ছেন। আর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই সনদের অভাবে তালিকায় নাম লেখাতে পারছেন না।

কমান্ডার জনাব আব্দুল লতিফের দ্বিতীয় ইচ্ছাটার বাস্তবায়ন আমরা চাই। প্রকৃত যারা মুক্তিযোদ্ধা আমাদের উচিত তাদেরকে সর্বোত্তম সহযোগিতা প্রদান করা। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। ইদানিং পত্র পত্রিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের খবর প্রতিনিয়তই প্রকাশিত হচ্ছে।

গত ২৭ অক্টোবর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে জানা যায় জামালগঞ্জে কথিত ২ মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেলেন, চাকরিও হল দুই মেয়ের। ৭ নভেম্বর আরেকটি জাতীয় দৈনিকে জানা যায় মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতির জন্যে অবসরে যেতে বাধ্য হলেন দুই সচিব। একই অভিযোগে সনদ বাতিল হয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকীর। অভিযোগ মাথায় নিয়ে ৩১ অক্টোবর অবসরে গেছেন তিনি। গত পাঁচ বছরে বর্তমান সরকারের সময়ে সরকারি-বেসরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা সহ বিভিন্ন পেশার মোট ১১ হাজার ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়েছেন।

জানা যায়, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) থেকে বলা হয়েছিল বিশেষ ক্ষেত্রে জরুরী প্রয়োজনে যদি কারও সনদের প্রযোজন হয় এবং সেটি যদি নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ঐ ব্যক্তি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তবেই মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিত মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী সনদ দেয়ার অধিকার রাখবেন। কিন্তু ব্যক্তিগত সর্ম্পক পরিচিতসহ অনেককেই শুধু আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্ত ও যাচাই বাছাই না করেই সনদ দেয়া হয়েছে। এ সুযোগে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অনেকেই সনদ নিয়েছেন।

মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, জামুকা সুপারিশ ছাড়া সনদ দেয়া হয়েছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয় উপসচিবসহ ১৯১ জন কর্মকর্তা কর্মচারীর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করেছে। দেশে এখনও অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন যাদের নাম তালিকায় আসেনি।

সুনামগঞ্জের প্রবীণ আইনজীবী মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ খসরু তাঁর এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা জাবেদ মিয়া ভোলাগঞ্জ সাব সেক্টরে প্রত্যক্ষভাবে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তার নাম নেই। যুদ্ধ শেষে জাবেদ মিয়া চলে যান পুলিশ বাহিনীতে কিন্তু মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ায় চাকুরী হারান তিনি। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় জন্যে আবার দরখাস্ত দিতে হবে সেটা তিনি জানেন না। তার ধারণা তিনি তো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, তার আবার কিসের দরখাস্ত। তিনি তো সব বলতে পারেন। ট্রেনিং সেন্টার, যুদ্ধ এলাকা, কমান্ডারের নাম সব কিছু তার মুখস্থ। যখন তিনি ভাল হয়ে দেখেন তিনি আর মুক্তিযোদ্ধা নন। সহ মুক্তিযোদ্ধারা ভাতা পেলেও তিনি পাচ্ছেন না। এক সময় বাঁচার জন্যে ভিক্ষার ঝুলি হাতে নেন। এখন তিনি ঘরে ঘরে ভিক্ষা করেন।’

বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা ভূক্তির কাজ চলছে। গত ৩১ অক্টোবর ছিল আবেদনের শেষ তারিখ। এড. জনাব খসরু শংকিত এই তালিকা প্রণয়নের ব্যাপারে। এতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা সবাই তালিকাভূক্ত হবেন কিনা। দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক ও নির্ভুল একটি তালিকা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবী। আমরা যারা স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্মের সন্তান তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের বীরগাঁথা গল্প শুনেছি।

আমাদের সৌভাগ্য যে এখনও আমরা চোখের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে পাচ্ছি। আমরা তাদের দুঃখ দুর্দশা দেখতে চাই না যাতে পত্র পত্রিকায় কোন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার জীবনের করুণ পরিণতির সংবাদ দেখতে না হয়। আমরা চাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করুন। দেশে যাতে আর কোন মুক্তিযোদ্ধা অর্থাভাবে চিকিৎসা বঞ্চিত না থাকেন। পারিবারিক ভাবে অসচ্ছল জীবন যাপন করতে না হয়।

সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব যথাযথ উদ্যোগের মাধ্যমে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে তাদেরকে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ পত্র প্রদানের ব্যবস্থা করা উচিত। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে দলীয় সুবিধা নিয়ে যাতে প্রভাবশালী ব্যক্তি যুদ্ধে অংশগ্রহণ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম তালিকাভূক্ত করতে না পারে। দেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এখনও অজানা। প্রতি সরকারের আমলেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সংশোধিত হচ্ছে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দিন দিন দেশে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত এখানে অমুক্তিযোদ্ধারাই বেশি প্রবেশ করছে। দেশের অনেক স্থানে স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠনের ব্যক্তিরাও তালিকায় নাম অন্তর্ভূক্ত করাচ্ছেন।

ডিসেম্ভর মাস বিজয়ের মাস। এ মাসেই দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশে ব্যস্ত থাকে। সারা বছর তাদের আর খোঁজ খবর তেমন একটা নেয়া হয় না। দেশে টিভি চ্যানেলগুলোতে যদি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নিয়মিত কোন অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা থাকত তাহলে নতুন প্রজন্মের সন্তানেরা দেশের এই সাহসী গর্বিত ব্যক্তিদের প্রকৃত অবস্থা জানত। তাদের মুখে যুদ্ধে অংশগ্রহণের বীরত্বপূর্ণ কাহিনীগুলো শুনতে পেত।

এমন এক সময় আসবে দেশে একজন মুক্তিযোদ্ধাও থাকবে না। তখন আপসোস থাকবে তাদের মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার। বাঙালি জাতির ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ হল একটি গৌরবগাঁথা ও ইতিহাস। এই ইতিহাসের যারা স্রষ্টা এবং যাদের রক্তের দ্বারাই এই ইতিহাস রচিত হয়েছে সেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাই আমাদের গর্ব। আমাদের সবার উচিত সেই গর্বিত সন্তানদের যোগ্য মর্যাদা প্রদানের মাধ্যমে জাতির এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসটাকে সমুন্নত রাখা।

লেখক: প্রভাষক, ইংরেজি, দিগেন্দ্র বর্মণ ডিগ্রি কলেজ, বিশ্বম্ভরপুর, সুনামগঞ্জ।

x