সিডর ও সিডরার গল্প

জীবনের প্রতীক সিডর ও সিডরা। আজ থেকে আট বছর আগে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে তাদের জন্ম। এই দিনে দেশের উপকূলীয় ১১টি জেলায় আঘাত হানা প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর। সে সময় ২৪০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানা এ ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারান সাড়ে তিন হাজার মানুষ। আর আহত ব্যক্তিদের সংখ্যা অর্ধলক্ষাধিক।

মহাদুর্যোগের ওই রাতে মংলার চিলা এলাকার সেন্ট মেরিস গির্জাসংলগ্ন আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়ে ছিলেন অস্তঃসত্ত্বা সাথী সরকার। আর পাশের গ্রাম দক্ষিণ কাইনমারীর মন্দিরের পাশের সাইক্লোন সেল্টারে আশ্রয় নেন অস্তঃসত্ত্বা সুখী ফলিয়া।

ঝড়ের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে যন্ত্রণাও যেন বাড়তে থাকে তাদের। রাত ১০টার পর সুখী ফলিয়ার কোলে আসে ফুটফুটে কণ্যা সন্তান। আর সাথী সরকার সূর্যোদয়ের আগে জন্ম দেন এক ফুটফুটে পুত্র সন্তান।

ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবলীলার মাঝেই উপকূলীয় মানুষের সংগ্রামী জীবনের প্রতীক হয়ে ওঠে ওই দুই নবজাতক। তাই ঝড়ের সাথে নাম মিলিয়ে কণ্যা সন্তানের নাম রাখা হয় সিডরা আর পুত্র সন্তানের নাম রাখা হয় সিডর।

শনিবার দুপুরে সিডর ও সিডরার বাড়িতে সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, ঝড় থেমে গেছে কিন্তু এখনো থামেনি তাদের হাহাকার। থামবেই বা কেন। প্রকৃতির রুদ্ররোষ মাথায় নিয়ে যে দুটি শিশু পৃথিবীতে এসেছিল, তারা কী করে যুদ্ধ ছাড়া চলবে? চলছে নিরন্তর বেঁচে থাকার যুদ্ধ। জীবনযোদ্ধা সিডর ও সিডরা সাত বছর পূর্ণ করে আজ পা রাখল আট বছরে।

সিডর গত বছর স্থানী দিশারী স্কুল থেকে ভালো ফল করে শিশু শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়। এখন পড়ছে সেন্ট লুক স্কুলে। আর সিডরা সেন্ট মেরিস পাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী। দুজই অত্যান্ত মেধাবী।

মংলার কানাইনগর গ্রামে সিডরের থাকার ঘরে গিয়ে দেখা মেলে তার দাদির। আর উঠানে খেলছে সিডর। চরম দারিদ্র্যে পড়ে সিডরের বাবা জর্জি সরকার (৩৩) ও মা সাথী সরকার (২৮) বছর তিনেক আগেই ঢাকায় পাড়ি জমান। কাজ নেন একটি পোশাক কারখানায়।

ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর চেষ্টায় এখন তাঁরা চট্টগ্রামে। আর শিশু সিডর বাবা-মা ছেড়ে দাদির ঘরে। চট্টগ্রামে সিডরের বাবা একটি দোকানে কর্মচারীর কাজ করেন। মা একটি পোশাক কারখানায়। দাদা রঞ্জিত সরকার সুন্দরবনে মাছ ধরার পেশা ছেড়ে চট্টগ্রামে একটি হোটেলে বাবুর্চির কাজ নিয়েছেন।

দাদি রিভা সরকার বলেন, “সিডরের বাবা-মা সংসার চালানোর জন্য ঢাকায় যাওয়ার পর থেকেই সিডর আছে আমার কাছে। কিন্তু অনেক টাকা দেনা হয়ে পড়ায় মাস পাঁচেক আগে সিডরের দাদু কাজের খোঁজে চট্টগ্রাম চলে যান। ওর বাবা-মা নিজেদের আয় দিয়ে নিজেরা ঠিকমতো চলতে পারেন না। তার পরও বাসায় কিছু টাকা পাঠান। দাদুও কিছু পাঠান। তা দিয়েই জোড়াতালিতে চলছে সিডরের পড়াশোনা আর খাওয়া খরচ।”

সিডর ক্লাসে প্রথমস্থান লাভ করেছে জানিয়ে রিভা সরকার আরো জানান- কয়েক বছর ধরে সিডর কানের যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু এখনো কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখানো সম্ভব হয়নি।

বড় হয়ে কী হবে প্রথাগত এই প্রশ্নে ছোট্ট সিডর খেলতে খেলতে উত্তর দেয়, ‘মানুষ হব। তারপর কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলে, ফাদার হব। মানুষের সেবা করব।

এদিকে সিডরের মত সিডরার জীবনে চলছে চরম নাটকীয়তায়।

সিডরার বাড়ি গিয়ে দেখা যায় সিডরের ক্ষত যেন শুকায়নি তাদের। ভাঙ্গাচুড়া একখানা ছোট্ট ঘর। উঠানে বসে রান্না করছেন সিডরার মা সুখী ফলিয়া (৩২)। সাংবাদিক দেখে দৌঁড়ে এসে বসতে দিলেন। নিজ থেকেই বল্লেন সিডরা স্কুলে।

সুখী ফলিয়া বলেন- অভাবের সংসার। স্বামী দিনমজুর তপন ফলিয়া (৪৭) ঢাকায় কাজ করে যে টাকা পাঠায় তাতে সংসার চলে।
সিডরা ছাড়াও তার আরো দুই সন্তান রত্মা (১৬) ও নয়ন (১৪)।

ছোট মেয়ে সিডরা অত্যান্ত মেধাবী জানিয়ে মা ফলিয়া বলেন, সেন্ট মেরিস পাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে সে এবং সে সব সময় ক্লাসে ফাষ্ট হয়। এই মেয়েকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। কিন্ত সেই স্বপ্ন দারিদ্রর কষাঘাতে মিলিয়ে যাবে কিনা সেই আশঙ্কা তাকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

মায়ের মুখে সিডরার গল্প শুনতে শুনতে চলে আসে সিডরা।

বড় হয়ে কি হবা জানতে চাইলে সিডরা বলে, তার স্বপ্ন -বড় হয়ে পুলিশ হবে। মানুষ ও দেশ সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে। (পরিবর্তন ডটকমের সৌজন্যে)

x