সিলেটে দেশের নান্দনিক শহীদ মিনারের উদ্বোধন

সিলেট: নান্দনিকতা আর ঐতিহ্যের মিশেলে পুনঃনির্মিত সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে।

বুধবার (১০ ডিসেম্বর) বিকেল সাড়ে ৪টায় পতাকা উত্তোলন ও পায়রা উড়িয়ে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

পতাকা উত্তোলন ও পায়রা ওড়ানোর পর সন্ধ্যা ৬টায় উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। পরে সাড়ে ৬টায় শহীদ মিনারের মুক্তমঞ্চে শুরু হয় সুধী সমাবেশ। সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন অর্থমন্ত্রী।

অর্থমন্ত্রী ছাড়াও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী ও সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে, শহীদ মিনার উদ্বোধন উপলক্ষে পুরো এলাকাকে সাজানো হয় বর্ণিল সাজে। চারদিকে রঙিন ফেস্টুন, রাস্তার বিপরীত পাশের দেয়ালগুলোতে তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্থিরচিত্র আর মূল সড়কে আঁকা হয়েছে বিশাল আল্পনা।

আয়োজন করা হয়েছে সাত দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের। দুপুর থেকেই লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে পুরো শহীদ মিনার এলাকা। বিকেল সাড়ে ৪টায় অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন হলেও মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় সন্ধ্যা থেকে। ফলে সন্ধ্যার পর মানুষের ভীড়ের কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয় জিন্দাবাজার-চৌহাট্টা সড়ক। তারপরও যেন তিল ধারণের ঠাঁই নেই।

সন্ধ্যা ৬টার দিকে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আসেন অতিথিরা। শুরুতেই তারা উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করেন। পরে শহীদদের স্মরণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। প্রথমে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নেতৃত্বে মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যরা পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

পরে পর্যায়ক্রমে শহীদ মিনার বাস্তবায়ন কমিটির নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সিলেট মহানগর ইউনিট, সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবিবের নেতৃত্বে সিসিকের প্রতিনিধিরা, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও সম্মিলিত নাট্য পরিষদের নেতৃবৃন্দ পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।

পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে শুরু হয় সুধী সমাবেশ। সমাবেশের শুরুতেই শহীদদের স্মরণে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়। পরে অতিথিদের সম্মাননা ক্রেস্ট ও উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া হয়।

শহীদ মিনার বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা সদর উদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশের শুরুতেই শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন মুক্তিযোদ্ধা, সংসদ সদস্যসহ সিলেটের বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

শুভেচ্ছা বক্তব্য পর্ব শেষে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, আজ একটি চমৎকার দিন। আজকের সন্ধ্যা অসাধারণ। আমার জীবনে এই দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

এসময় তিনি সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণ শৈলীর দিক থেকে দেশের সুন্দরতম এবং দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা বলে উল্লেখ করেন।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে তিনি আরো বলেন, শহীদ মিনার আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এটা আমাদের চেতনা। এই শহীদ মিনারকে রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী বলেন, দুর্বৃত্তরা শহীদ মিনার ভেঙে দিলেও আমাদের অন্তর থেকে শহীদ মিনারকে সরাতে পারেনি, পারবেও না।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অল্প সময়ে এমন দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারার জন্য সিলেটের মানুষের অসংখ্য সমর্থনের কথা উল্লেখ করেন।

এছাড়া শহীদ মিনারকে জাতীয় প্রতীক উল্লেখ করে তিনি বলেন, শহীদ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আর স্মৃতিসৌধ মুক্তিযোদ্ধের প্রতীক। সিলেটে পুনঃনির্মিত এই শহীদ মিনারে দুটোকেই একত্রিত করা হয়েছে। এজন্য তিনি এই মিনারের স্থপতি অধ্যাপক শুভজিৎ চৌধুরীর প্রশংসা করেন।

তিনি আরো বলেন, একাত্তরের পরাজিত শক্তিদের উত্তরসুরীরা আমাদের প্রাণের শহীদ মিনারে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেছে। ওরা পরাজিত শক্তি। তারা জানে না বিজয়ী জাতিকে রুখে দেওয়া যায় না। আমাদের চেতনা সমুজ্জল থাকবে সর্বদা। কোনো পরাজিত শক্তির কাছে আমরা মাথা নত করবো না।

তিনি বলেন, একুশ মানে মাথা নত না করা। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের ভাষার অধিকার অর্জন করেছি। একুশকে অর্জন করেছি। সেই একুশ চির ভাস্বর হয়ে থাকবে।

সুধী সমাবেশ শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীসহ জাতীয় ও স্থানীয় শিল্পীরা গান পরিবেশন করেন।

এর আগে বিকেলে দেশের গান ছাড়াও বাউল গান, মনিপুরী নৃত্য পরিবেশন করা হয়।

এদিকে সাত দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে সিলেটের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর বিভিন্ন পরিবেশনা বিজয় দিবসের দিন পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে চলবে।

পঁচিশ বছর আগে সিলেটে চারজন মুক্তিযোদ্ধার সাহসিক প্রচেষ্টা ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সহযোগিতায় চৌহাট্টায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। সে সময়ের প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন আর সামাজিক সমর্থনে তৈরি শহীদ মিনার কালস্রোতে সিলেটের সাংস্কৃতিক চেতনার প্রতীক।

২০১৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তৌহিদি জনতার মিছিল থেকে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হামলা চালায় জামায়াত-শিবির। তাদের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শহীদ মিনার। এরপর সিলেটের সংস্কৃতি কর্মীরা শহীদ মিনার নতুন করে নির্মাণের জন্য অর্থমন্ত্রীর কাছে দাবি জানান। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রীর নির্দেশে শহীদ মিনার পুনঃনির্মাণের কাজ শুরু করে সিসিক।

প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যায়ে পুনঃনির্মিত নান্দনিক শিল্পকর্মের এ স্থাপত্যে প্রস্ফুটিত হয়েছে চা বাগানের ফাঁকে ভোরে নবদিগন্তে সূর্যের রক্তিম আলোকছটা আর আবহমান বাংলার সংগ্রামী চেতনার বিদ্রোহের চিত্র।

শহীদ মিনারের নকশাবিদ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক শুভজিৎ চৌধুরী জানান, চেতনায় আন্দোলিত ভূমি থেকে জেগে ওঠা বাঙালির আবহমান সংগ্রামী ঐতিহ্য। বিদ্রোহ নিয়েই আমাদের গৌরব, বাঙালি জাতির বিদ্রোহে ভূমি যে অংশ নেয় তার বহিঃপ্রকাশ শহীদ মিনারের স্থাপত্য শৈলীতে দেখানো হয়েছে।

তার সহযোগী স্থপতি হিসেবে কাজ করেন কৌশিক সাহা, সিপাউল বর চৌধুরী, ধীমান চন্দ্র বিশ্বাস ও জিষ্ণু কুমার দাস। গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী।

পুনঃনির্মিত এই শহীদ মিনার ১০০ ফুট চওড়া ভূমির ওপর ৪৫ ফুট উঁচু স্তম্ভটি ছাড়াও অন্যান্য স্থাপনার মধ্যে রয়েছে, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আলাদা র‌্যাম্প, ভূগর্ভস্ত প্রদর্শনী কেন্দ্র ও গ্রন্থাগার, মুক্তমঞ্চ, অনুশীলন কক্ষ, গ্রিনরুম ও ব্যাক স্টেইজ এবং সম্মুখ চত্বর।

শহীদ মিনারে ভূগর্ভস্থে প্রদর্শনী কক্ষে একটি কর্নার থাকবে যেখানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রকাশনা রাখা হবে। কেউ চাইলে বসে পড়াশোনা ও বই কিনে নিয়ে যেতে পারবেন। এছাড়া, ঢাকার ছবির হাটের ধরনে আউটডোরে প্রদর্শনী কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।

x