তোমাকে আসতেই হবে হে স্বাধীনতা

ঢাকা: ‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে/জ্বলন্ত ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে, নতুন নিশানা উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক/এই বাংলায়/তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।’

প্রয়াত কবি শামসুর রাহমানের এই কবিতা একাত্তর সালের এই দিনে সত্যি হয়ে দেখা দিয়েছিল বাঙালির জাতীয় জীবনে।

বাঙালি জাতির জীবনে তাই আজ এক আনন্দের দিন। এমনি এক দিনের প্রতীক্ষায় কেটেছে আমাদের হাজারো বছর। বহু কাঙ্খিত সেই দিনটির দেখা মিলেছিল ১৯৭১ সালে, ১৬ ডিসেম্বর। ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ৪৩ বছর আগের এদিনে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী হাতের অস্ত্র ফেলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল বিজয়ী বীর বাঙালির সামনে। স্বাক্ষর করেছিল পরাজয়ের সনদে। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের।

আজ সেই ১৬ ডিসেম্বর। রক্তস্নাত বিজয়ের ৪৩তম বার্ষিকী। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রাম করে বহু প্রাণ আর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এদিনে দামাল বাঙালি ছিনিয়ে আনে বিজয়ের লাল সূর্য।

বিজয়ের ৪৩ বছর কেটে গেলও অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে চলছে স্বাধীন এ দেশটি। হাজারো প্রতিবন্ধকতার কারণে এখনও স্বনির্ভর হতে পারেনি বাংলাদেশ। স্বাধীনতা অর্জিত হলেও গত ৪৩ বছর জাতির চলার পথ মসৃণ ছিল না কখনো। এর মধ্যে আমাদের অনেক চড়াই-উৎরাই মোকাবিলা করতে হয়েছে। রাজনীতি এগিয়েছে অমসৃণ পথে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনাকাঙ্খিত ঘটনায়।

জনবহুল ও সীমিত সম্পদের এ দেশকে স্বনির্ভর করে তোলার কাজও সহজ ছিল না। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কঠিন দিনগুলোয় রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্র চালু করতে হয়েছিল। স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি সংবিধানও প্রণয়ন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রয়োজন ছিল গণতান্ত্রিক ও মুক্ত পরিবেশে নিরবচ্ছিন্ন যাত্রার। সদ্যস্বাধীন দেশের নেতৃত্বের এ বিষয়ে অঙ্গীকারের অভাব ছিল না। দুর্ভাগ্যজনক যে, পরে এক্ষেত্রে মারাত্মক বিচ্যুতি ঘটে এবং তার খেসারত দিতে হয় জাতিকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে তুলনামূলক উন্নতি হলেও মানবসম্পদ সূচকে আজও বিশ্বসমাজের পেছনের সারিতে আমাদের অবস্থান। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়লেও দারিদ্রতা এখনও প্রকট। নতুন করে জনসংখ্যার ঊর্ধ্বগতি এ সমস্যা বাড়িয়ে তুলছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলেও সুশাসন যেন সোনার হরিণ।

হাজারো সমস্যার মাঝেও দেশে নারী ও শিশু মৃত্যুর হার কমেছে, বেড়েছে শিক্ষার হার, তথ্য-প্রযুক্তিতে এগুচ্ছে বাংলাদেশ। নোবেল বিজয় এবং ক্রিকেটের কারণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বেড়েছে বাংলাদেশের পরিচিতি। ব্যর্থতার তুলনায় সফলতার পাল্লায় ভার কম থাকলেও এগুলো আশা দেখাচ্ছে বাংলাদেশকে।

৪৩ বছর বয়সী বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়া, দারিদ্রতা ও দুর্নীতি থেকে মুক্তির সংগ্রামের পাশাপাশি একইভাবে চলেছে সামরিক শাসন, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, যুদ্ধাপরাধের বিচার, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ আন্দোলন। এসব আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যেই মোকাবিলা করতে হয়েছে প্রবল বন্যা, ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের। এই বন্ধুর পথপরিক্রমায় অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। কিন্তু শত বাধা-প্রতিবন্ধকতাতেও হতোদ্যম হয়নি এ দেশের মানুষ। হারায়নি সাহস। লাল-সবুজ পাতাকা উড়িয়ে অব্যাহত আছে বাঙালির এগিয়ে যাওয়া।

মঙ্গলবার কৃতজ্ঞ জাতি সশ্রদ্ধ বেদনায় স্মরণ করবে দেশের পরাধীনতার গ্লানি মোচনে প্রাণ উৎসর্গ করা বীর সন্তানদের। সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে জনতার ঢল নামবে। শ্রদ্ধার সঙ্গে তারা শহীদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করবেন পুষ্পাঞ্জলি। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সব প্রান্তের মানুষ অংশ নেবে বিজয় দিবসে। বঙ্গবন্ধুর বজ্র নিনাদ ভাষণ আর মুক্তিযুদ্ধের সময়ের জাগরণী গানে আকাশ-বাতাস হবে মুখরিত।

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং জাতীয় সংসদে বিরোধীদলের নেতা রওশন এরশাদ এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া মহান বিজয় দিবসে পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

বিজয় দিবস সরকারি ছুটির দিন। এদিন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোর প্রধান সড়ক ও সড়ক দ্বীপ জাতীয় পতাকায় সজ্জিত করা হবে। রাতে গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় করা হবে আলোকসজ্জা। হাসপাতাল, কারাগার ও এতিমখানাগুলোতে উন্নত মানের খাবার পরিবেশন করা হবে। অনলাইন ও কাগজের সংবাদপত্র বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করবে। বেতার ও টিভি চ্যানেলগুলো সম্প্রচার করবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।

এবারের বিজয় দিবস উদযাপনের সঙ্গে যোগ হয়েছে ভিন্ন মাত্রা। শোক আর রক্তের ঋণ শোধ করার গর্ব নিয়ে উজ্জিবিত জাতি দিবসটি পালন করবে অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে। অফুরন্ত আত্মত্যাগ এবং রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই মহান বিজয়ের ৪৩ বছর পূর্ণ হলো আজ। গত বছর বিজয় দিবসের মাত্র কয়েক দিন আগে ১২ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধের দায়ে দন্ডিত আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় স্বভাবতই অনুপ্রাণিত ছিল দেশবাসী। মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত অন্তত একটি মামলার রায় কার্যকর হওয়ায় বাকী যুদ্ধাপরাধীদেরও একই পরিণতি হবে এই আশাবাদ এবং প্রত্যাশা করছেন স্বাধীনতার স্বপক্ষের মানুষরা।

কর্মসূচি: প্রত্যুষে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে দিবসটির সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তববক অর্পণের মাধ্যমে একাত্তরের শহীদদের শ্রদ্ধা জানাবেন। বিরোধীদলের নেতা রওশন এরশাদ অনুরূপভাবে সাভারে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করবেন।

এছাড়াও বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রাজধানীর বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ কর্মসূচি নিয়েছে।

এর মধ্যে সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া, মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

সকাল ৮টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। সকাল ১০ টায় টুঙ্গীপাড়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনসহ জিয়ারত, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল।

বিএনপিও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাসদ, বাসদ, ওয়ার্কাস পার্টিসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন করবে।

x