বীরাঙ্গনা-যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসন করতে হবে রাষ্ট্রকেই

ঢাকা: একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত বীরাঙ্গনা নারী ও যুদ্ধশিশুদের ক্ষতিপূরণ স্কিম চালু করার জন্য রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে বলেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। পাশাপাশি তালিকা করে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করার জন্য বলেন ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনাল তাদেরকে আমাদের দেশের জাতীয় বীর বলেও উল্লেখ করেন।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদেণ্ডাদেশ দিয়ে জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে এসব কথা বলেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহীনুর ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ রায় দেন।

মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) রায়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজের নামে ‘কায়সার বাহিনী’ নামে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী বাহিনী গঠন করে যুদ্ধাপরাধ সংঘটনকারী হবিগঞ্জ মহকুমার রাজাকার কমান্ডার কায়সারের বিরুদ্ধে হত্যা-গণহত্যা, নির্যাতন, আটক, মুক্তিপণ আদায়, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন এবং ষড়যন্ত্রের ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ১৪টিই প্রমাণিত হওয়ায় তাকে সর্বোচ্চ দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।

প্রসিকিউশন এ মামলায় ভিকটিমদের জন্য যে ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছিলেন সে বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল তার পর্যবেক্ষণে বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩-এ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান না থাকায় ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দিতে পারছেন না। তাই রাষ্ট্রকেই নির্যাতিত বীরাঙ্গনা নারী ও যুদ্ধশিশুদের ক্ষতিপূরণ স্কিম চালু এবং তালিকা করে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।

এক্ষেত্রে সরকারের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা এবং এনজিওগুলোকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য বলেছেন।

কায়সারের মামলায় প্রথমবারের মতো একজন যুদ্ধশিশু ও দুই বীরাঙ্গনাকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি করেছিলেন প্রসিকিউশন। কায়সারের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপনকালে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিতা হয়ে বীরাঙ্গনা মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া ওই যুদ্ধশিশু ও দুই বীরাঙ্গনাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছিল।

শামসুন্নাহার নামের ওই যুদ্ধশিশু দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রপক্ষের দশম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন কায়সারের যুদ্ধাপরাধ মামলায়। ৪২ বছর বয়সী নারী সাক্ষী শামসুন্নাহার কায়সারের ধর্ষণের শিকার হওয়া একজন বীরাঙ্গনা মায়ের গর্ভে জন্ম নিয়েছেন। বীরাঙ্গনা দু’জন সাঁওতাল নারী হীরামনি ও মাজেদাও এ মামলায় কায়সারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

কায়সারের বিরুদ্ধে হীরামনি ও মাজেদাকে ধর্ষণের অভিযোগ দু’টিও প্রমাণিত হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। অন্যদিকে এই প্রথমবারের মতো ধর্ষণের দায়ে কোনো যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দিলেন ট্রাইব্যুনাল।

প্রসিকিউশন কায়সারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে এ তিনজনকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। কায়সারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি না পাওয়া গেলে রাষ্ট্র তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দেবে বলেও দাবি করেন প্রসিকিউশন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যেসব নারী বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তারা আমাদের দেশের জাতীয় বীর। ট্রাইব্যুনাল বলেন, আজ আমাদের সময় এসেছে বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার। ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দেওয়ায় যুদ্ধশিশু শামসুন্নাহারকে সাহসিকতার জন্য স্যালুট জানান ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনাল সকল নির্যাতিত নারী ও বীরাঙ্গনাদেরও স্যালুট জানিয়ে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযদ্ধের পরপরই মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পুর্নবাসনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকার। নিঃসন্দেহ এ উদ্যোগ ইতিবাচক।

এসব জাতীয় বীরদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত ছিল। যদিও তাদের ত্যাগ এবং অসীম ক্ষতি পূরণযোগ্য নয় তবু ক্ষতিপূরণ এবং পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল।

আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিদ্যমান আইনে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুযোগ নেই উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এতোদিন রাষ্ট্র সমাজ এসব জাতীয় বীরদের বিষয়ে যে নীরবতা এবং অমনোযোগিতা প্রকাশ করেছে এখন সেটা করার আর কোনো সুযোগ নেই।

কায়সারের বিরুদ্ধে প্রমাণিত ১৪ অভিযোগের মধ্যে ৭টিতে অর্থাৎ ৩, ৫, ৬, ৮, ১০, ১২ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে ফাঁসির আদেশ পেয়েছেন তিনি। ৪টি অর্থাৎ ১, ৯, ১৩ ও ১৪ নম্বর অভিযোগে তাকে দেওয়া হয়েছে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ। এছাড়া ২ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর, ৭ নম্বর অভিযোগে ৭ বছর এবং ১১ নম্বর অভিযোগে ৫ বছর মিলিয়ে আরও ২২ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে তাকে। প্রমাণিত না হওয়া ৪ ও ১৫ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন কায়সার।

x