বঙ্গবন্ধুকে রাজাকার বললেন তারেক
লন্ডন: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে আবারও বিতর্কিত মন্তব্য করলেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এবার জাতির জনককে মানুষ হত্যাকারী বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি।
বিজয় দিবস উপলক্ষে সোমবার লন্ডনে বিএনপির এক আলোচনা সভায় বক্তব্যে বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক দাবি করেছেন, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা আসার ঠিক আগে ইয়াহিয়া খানকে প্রেসিডেন্ট মেনে তার সঙ্গে সমঝোতা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ইস্ট লন্ডনের অ্যাট্রিয়াম ব্যাংকোয়েট হলে যুক্তরাজ্য বিএনপি আয়োজিত ওই আলোচনা সভায় দলের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক আবারও তার বাবা জিয়াকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক ও প্রথম রাষ্ট্রপতি বলে দাবি করেন।
শায়েস্তা চৌধুরী কুদ্দুসের সভাপতিত্বে ও কয়েস আহমেদের পরিচালনায় শুরু হওয়া এই সভায় বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মীর মো. নাছিরউদ্দিনও ছিলেন।
বিএনপির ৫০০ শতাধিক নেতা-কর্মী-সমর্থক এই সভায় যোগ দেন, যার ব্যানারে প্রধান অতিথি তারেককে ‘দেশনায়ক’ বলা হয়।
আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ছিল না দাবি করে এর পক্ষে এ কে খন্দকার এবং বদরুদ্দীন উমরের লেখা উদ্ধৃত করে শোনান তারেক।
তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান যদি ৭ মার্চ সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসারদের নিয়ে যুদ্ধ শুরু করতেন, তাহলে যে ‘সামান্য সংখ্যক’ পাকিস্তানি সৈন্য তখন ছিল, তাদের সহজেই পরাজিত করা যেত; প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষতি ‘অনেক কমানো’ যেত।
“এই সব কিছু জানার পর এর জন্য আমরা এককভাবে কাকে দায়ী করতে পারি? শেখ মুজিবকে। এবং আমরা তাকে যেভাবে রাজাকার বলেছি, আমরা তথ্য প্রমাণ সত্য দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করে তাকে বলেছি- রাজাকার। আমরা সত্য ঘটনাবলীর ভিত্তিতে বলেছি সে ছিল পাকবন্ধু।”
এরপর তারেক বলেন, “আজকে যদি আমরা বলি- এই যে লক্ষ লক্ষ মানুষ একাত্তর সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে মারা গেল, এই যে হাজার হাজার মা বোনোর সম্ভ্রম নষ্ট হল, এর জন্য এককভাবে কী শেখ মুজিবকে দায়ী করা যায়? তাহলে এতো মানুষের যে হত্যাকারী তাকে এক বাক্যে কী বলা উচিৎ? যে মানুষ মারে তাকে কি বলা উচিৎ?”
উপস্থিত বিএনপি কর্মীরা এ সময় চিৎকার করে উত্তর দেন- ‘রাজাকার’।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এর আগেও বিতর্কিত মন্তব্য করা তারেক বলতে থাকেন, “আওয়ামী লীগ দাবি করে তারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দল, মুক্তিযুদ্ধের দল। এই দলকে শেখ মুজিব কি করল- ব্যান করে দিল। আরে তুমি তো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রাজাকাররে ভাই।.. মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দলকে তুমি ব্যান করে দিলে, তা তো মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় বিপক্ষের কাজ হল। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের কাজ কে করবে ভাই? একজন রাজাকারই তো করবে। তাহলে শেখ মুজিবকে কি বলা যায়? বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়…।”
বিএনপিকর্মীরা তারেকের হয়ে উত্তর দেন ‘রাজাকার, খুনি’।
১৯৭১ সালের ১৭ থেকে ২৫ মার্চের ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরে তারেক বলেন, তখন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সমঝোতা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর।
“১৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন, ২৫ মার্চ পর্যন্ত ছিলেন .. শেখ মুজিব এক অফিসারকে বলেছিলেন, ১১ জনের বিষয়ে সমঝোতার কথা, তা হয়েছিল এই সময়েই।”
“১১ জন মন্ত্রীর ব্যাপারে জাতীয় সরকার গঠনের শেখ মুজিবের সঙ্গে ইয়াহিয়ার মতৈক্য হয়েছিল। এখানেই কিন্তু শেষ নয়, ২৪ মার্চ আবার শেখ মুজিব ও ইয়াহিরার প্রতিনিধিদের আলোচনায় চারটি বিষয়ে মতৈক্য হয়েছিল। … শেখ মুজিব কিন্তু ইয়াহিয়াকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে এক্সসেপ্ট করে নিয়েছিলেন।”
জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করে তিনি এর পক্ষে স্বাধীনতার পর সংবাদপত্রে প্রকাশিত জিয়ার একটি নিবন্ধ তুলে ধরেন তিনি।
‘একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামের ওই লেখায় জিয়া বলেছিলেন- বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তার জন্য ছিল ‘গ্রিন সিগন্যাল’।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আওয়ামী লীগ বিকৃত করছে দাবি করে তারেক বলেন, “গত ৪০ বছর ধরে আমরা একটি দলের মিথ্যা মিথ্যা মিথ্যা বারবার শুনে এসেছি।”
“এই দখলদার রং হেডেড শেখ হাসিনা একটার পর একটা অপকর্ম করেই চলেছে। যখনই বিপদে পড়ে, বিপদে পড়লেই জনগণকে ধোঁকা দিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে।”
তারেক বলেন, সেজন্য মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের ভূমিকা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা এখন সময়ের দাবি মনে করেন তিনি।
২১ অগাস্টসহ বিভিন্ন মামলা মাথায় নিয়ে ছয় বছর ধরে লন্ডনে থাকা তারেক প্রবাসে বিএনপির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। লন্ডন থেকে মালয়েশিয়া গিয়ে একটি সভায়ও যোগ দেন তিনি।
এর মধ্যে গত ৭ নভেম্বর তিনি এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে ‘পাকবন্ধু’ আখ্যায়িত করেন এবং তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা করার দাবি তোলেন।
অগাস্টে এক সভায় বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারকে ‘বাংলাদেশের অভিশাপ’ এবং আওয়ামী লীগকে ‘কুলাঙ্গারের দল’ বলেন তারেক।
কয়েক মাস আগে আরেক সভায় নিজের বাবা জিয়াউর রহমানকে ‘বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি’ বলে দাবি করেন তারেক। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে ‘অবৈধ প্রধানমন্ত্রী’ বলেন তিনি।
এসব বক্তব্যের জন্য ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের তীব্র বাক্যবাণ তারেককে লক্ষ্য করে। সেইসঙ্গে তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবিও উঠেছে।
টানা কয়েকটি সভায় বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য বাংলাদেশে তারেকের বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগে কয়েকটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে একটিতে জারি হয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।