ওল্ডহামে কিছু স্মৃতি: বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও প্রথম বিজয় দিবস পালন (২)

ইংল্যান্ডের বড় এক শহর ওল্ডহাম। পুরো এলাকাজুড়ে আছেন অনেক বাঙ্গালী, যারা প্রবাসে বসেও দেশকে নিয়ে ভাবেন প্রতিমুহূর্তে। ওল্ডহামে বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও বিজয় দিবস পালন নিয়ে প্রবাসী আব্দুল মালিক স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন সুনামগঞ্জ মিরর ডটকমে। আমাদের প্রিয় পাঠকদের জন্য আজ থাকছে এর দ্বিতীয় পর্ব।

——————————————————–

জানুয়ারি ১৯৯১ ইং একদিন বিকাল বেলায় বেড়াতে গেলাম রাস্তার, “নাম চাডারটনওয়ে”, একটি ভিডিও সেন্টার এর মালিক হচ্ছেন কুতুব উদ্দিন। প্রতিদিন বিকাল বেলায় যুবকদের বেশ আড্ডা জমে উটে ওই ভিডিও সেন্টারে। পরিচয় হয়ে গেল কুতুব উদ্দিন ভাইয়ের সাথে তার পর দেলোয়ার ভাইয়ের সাথে। অনেক আলোচনা হয়ে গেল এর মধ্যে গুরুত্তপূর্ণ বিষয় হল, যেহেতু ওল্ডহাম অনেক বাঙ্গালী, একটা কমিউনিটিও রয়েছে এবং ওল্ডহাম বাংলাদেশ এসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন ও রয়েছ, কিন্তু নেই কোন কালচারেল একটিভিটিস। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, সহ ১লা বৈশাখ আসে আবার চলে যায় কিন্তু নেই কোন একটিভিটি (প্রোগ্রাম)।

আলোচনা হল, আসুন আমরা যুব সমাজ মিলে একটি সংগঠন করি যাতে প্রতি বৎসর আমরা সবাই মিলে আমাদের জাতীয় দিবস সহ বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারি। এতে আমাদের নতুন প্রজন্মরাও অনেক কিছু জানতে ও শিখতে পারবে। তারা দু’জনই আমার সাথে একমত হলেন এবং লিফলেট তৈরি করে যে কয়েকটি দোকান আছে সে গুলোর উন্ডরের উপরে লাগিয়ে প্রচারকাজ চালানোর পরামর্শ দিলেন। ঠিক তাদের কথা অনুযায়ী কয়েকটি পোস্টার হাতে লিখে দোকানে দোকানে রাখলাম।

এতে লিখলাম, “সম্মানিত ওল্ডহামবাসী আগামী ১৯৯১ ইং রোববার কোল্ডহাস্ট ক্লার্কওয়েল কমিউনিটি সেন্টারে দুপুর ১২ঘটিকায় একটি যুব সংগঠন গঠন করার উদ্দ্যেশে এক মত বিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছে। এতে অল্ডহামের সকল যুব সম্প্রদায়ের উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ রহিল। বিস্তারিত জানার জন্য যোগাযোগ করুন কুতুব ভিডিও সেন্টার।"

সেদিন ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন, দেলোয়ার হোসেন, কুতুব উদ্দিন, মোজাহিদ খাঁন, সাইফুল আলম, সাজিদুর রাহমান, জাহির উদ্দিন, নুরুল আলী, ওয়াহিদুর রাহমান এবং আমি নিজে। ঐদিন সভায় কোন সিদ্ধান্ত হয় নাই এর কারণ সাফুল এবং মোজাহিদ উল্লেখ করলেন, ইয়ুথ এসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন রয়েছে সুতারাং আমাদের উচিৎ হবে ঐ সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে কার্যক্রম শুরু করা। আবার এই সভায় বেশিরভাগ বললেন এ ধরনের কোন সংগঠন আছে বলে তদের জানা নেই। আমি এই সভায় সাইফুল ও মোজাহিদকে অনুরোধ করলাম, ইয়ুথ এসোসিয়েশনের দায়িত্বে যারা আছেন তাদের সাথে যোগাযোগ করে একটি সভা ডাকার জন্য। এর কিছু দিন পর মোজাহিদ খান আমাকে জানালেন অল্ডহাম বাংলাদেশ ইয়ুথ এসোসিয়েশনের সভা ডাকা হবে আমি যেন ঐ সভায় উপস্থিত থাকি। আমিও মোজাহিদকে অনুরোধ করলাম অন্যান্য সকলকে যেন ঐ সভায় দাওয়াত দেওয়া হয়।

এরপর একদিন বিকাল বেলায় মোজাহিদ এবং ওয়াহিদুর রাহমান আমাকে নিয়ে গেলেন আব্দুল করিম এর বাসায়। এই প্রথম পরিচয় করিম ভাইয়ের সাথে, করিম ভাই তখন ওল্ডহাম কাউন্সিলের এতনিক মাইনোরিটি প্রিন্সিপাল অফিসার পোস্টে কাজ করতেন। অনেক আলোচনা, করিম ভাই আমাকে জানালেন ওল্ডহাম বাংলাদেশ ইয়ুথ এসোসিয়েশন প্রায় ৬ বৎসর হয়ে গেছে এবং এর মাধ্যমে এ পর্যন্ত শুধু ফুটবল খেলা ছাড়া আর কিছুই হয় নাই। এছাড়াও এই সংগঠনের সাথে যারা জড়িত ছিলেন তারা খেলাধুলা ছাড়া আন্য কিছু ভাবেন নাই।

আমি উনাকে বললাম একটি সংগঠন শুধু খেলাধুলা করার জন্য নয়, সংগঠনের মাধ্যমে আমরা অনেক কিছু করতে পারি। তাছাড়া একজন সচেতন মানুষ হিসাবে আমাদের উচিৎ, এদশে বড় হওয়া নতুন প্রজন্মকে আমাদের সাহিত্য সাংস্কৃতির সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। আমরা যদি খেলা ধুলার পাশাপাশি আমাদের জাতীয় দিবস ও সাহিত্য সাংস্কৃতি গুলিকে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করি তাহলেই এদেশের নতুন প্রজন্মরা জানতে পারবে আমাদের সঠিক কালচার ও ইতিহাস। তিনি নতুন করে সবাইকে নিয়ে ওল্ডহাম বাংলাদেশ ইয়ুথ এসোসিয়েশনকে পূর্ণগঠিত করতে চান। খুব শিঘ্রই একটি সভা ডাকার সিদ্ধান্ত নিলেন।

ওল্ডহাম বাংলাদেশ ইয়ুথ এসোসিয়েশনের পুরো কার্যক্রম এখান থেকেই শুরু হয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বাহিরে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের চেতনা এখান থেকেই শুরু হয়। এপ্রিল প্রথম সপ্তাহ ১৯৯১ইং ওল্ডহাম বাংলাদেশ ইয়ুথ এসোসিয়েশনের প্রথম সভা ডাকা হয়। স্থান ওল্ডহাম বাংলাদেশ কালচারেল সেন্টার, রোববার সময় বিকাল ৬ ঘটিকা।

এতে উপস্থিত ছিলেন, আব্দুল করিম, মোজাহিদ খাঁন, সাজিদ আলী, সাইফুল আলম, নুরুল আলী, দেলোয়ার হোসেন, ওয়াহিদুর রাহমান, আবদুল মতিন, সাদরুল আলম, লুসন মিয়া এবং আমি নিজে (আব্দুল মালিক)। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আলোচনার ভাষা ছিল ইংরেজীতে, কারণ এই সভার অধিকাংশই (বর্ণ এন্ড ব্রডআপ) ইংলেন্ডে জন্ম এবং বড় হয়েছেন আর কিছু সংখ্যক অনেক ছোট বেলা মা বাবার সাথে ইংলেন্ডে এসেছেন। যার ফলে ইংরেজী হচ্ছে তাদের প্রধান ভাষা। তারা কিন্তু বাংলায় ভাল ভাবে কথা বলতে পারেন না।

বাংলাদেশ তাদের অনেকের কাছে যেন একটা স্বপ্ন রাজ্য। সভা চলা অবস্থায় করিম ভাই আমাকে জিজ্ঞাশা করলেন, আমি আলোচনা বুঝতে পারতেছি কি না। হঠাত করিম ভাই এই প্রশ্ন করায় আমি একটু স্বস্তিবোধ করলাম, বললাম আমি বুঝার চেষ্টা করতেছি এবং আমাকে বুঝতেই হবে। ইংলেন্ডের কালচারে বড় হয়েছেন তারা, আমি বুঝতে পারলাম তাদের সাথে আমাকে মানিয়ে নেওয়া খুব কষ্ট হবে। তারপরও আমাকে মানিয়ে নিতে হবে। ঐ দিন নতুন ভাবে ওল্ডহাম বাংলাদেশ ইয়ুথ এসোসিয়েশনের কার্যকরী পরিষদের কমিটি পূর্ণগঠন করা হয় এবং এতে আব্দুল করিম সভাপতি, ওয়াহিদুর রাহমান সহ সভাপতি, আব্দুল মতিন সেক্রেটারি, এই সভায় আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রেস, মার্কেটিং, সাহিত্যক এবং সাংকৃতিক বিষয়ক সম্পাদকের। ২৯শে আগষ্ট ১৯৯১ইং রোববার ওল্ডহাম বাংলাদেশ ইয়ুথ এসোসিয়েশনের সভা বসে। এতে উপস্থিত ছিলেন, আব্দুল করিম, আলাল মিয়া, লুছন মিয়া, কিজির আহমেদ, নুরুল আলী, ইয়াজুল ইসলাম, রবিউল হাসান খাঁন, সাইফুল আলম, মুহিবুর রাহমান, তোয়াহিদুর রাহমান, সাদরুল আলম, আব্দুল করিম, ওয়াহিদুর রাহমান, আব্দুল মতিন এবং আমি নিজে।

(১) সদস্য পদ উম্মুক্ত রেখে কার্যকরী পরিষদের সংখ্যা আর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ছাড়াও কার্যকরী পরিষদে দুই জন মহিলা সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মহিলা সদস্যরা হলেন, শেলী রাহমান ও রহিমা বেগম।

(২) কার্যকরী পরিষদের সভা প্রতি মাসে একটা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং সকলের সুবিদা অনুযায়ী শনিবার ২ টায় নির্ধারণ করা হয়।

(৩) কমিউনিটির সকল কার্যক্রমকে আর জোড়ালো করার জন্য দুইটি সাবকমিটি গঠন করা হয়। প্রথম কমিটির (এ) দায়িত্ব হলঃ ইডুকেশন, ইমপ্লয়মেন্ট, সসিয়েল, কালচারেল এবং স্পোর্টস। দ্বিতীয় কমিটি (বি) দায়িত্ব হলঃ হাউজিং, উরবান রেনুয়াল, রেলিজিয়ন এবং পলিটিক্স।

প্রথম এ কমিটির দায়িত্বে ছিলেন: সাদরুল আলম, রবিউল খাঁন, মাসুকুল হক, আব্দুল মালিক (আমি) এবং ইয়াজুল ইসলাম।

দ্বিতীয় বি কমিটির দায়িত্বে ছিলেন: সাইফুল আলম, তোয়াহিদুর রাহমান এবং লুসন মিয়া।

এ সভায় তিনটি প্রোগ্রামের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ব্যাডমিন্টন, ফুটবল এবং টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতা। ব্যাডমিন্টন ও টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতার দায়িত্বে রবিউল, সাদরুল, কিজির এবং তুয়াহিদুর। ফুটবল প্রতিযোগিতার দায়িত্বে ইসরাক আলী ও সাইফুল আলমকে দেওয়া হয়। আপাদত এই সব কর্মসুচি আয়োজন করার জন্য অল্ডহাম বাংলাদেশ কালচারেল সেন্টারকে ব্যবহার করা হবে। এই সব কর্মসুচির জন্য অর্থের প্রয়োজন তাই ফান্ডিং এর জন্য কাউন্সিলে এপ্লাই করা যেথে পারে।

(চলবে)

x