ইতিহাস ও সৌন্দর্যের ইংলিশ টিলা

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য এক লীলাভূমি আমাদের সুনামগঞ্জ। এখানকার প্রকৃতি আমাদের আত্মাকে শুদ্ধ করে এবং দেহকে করে চাঙা। আপনি যদি পাহাড় থেকে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করতে চান এবংপুরোনো ইতিহাসটা একটু খুঁজে দেখতে চান তবে ছাতক হতে পারে আপনার জন্য একটি আদর্শ জায়গা। সুনামগঞ্জের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত ছাতক উপজেলায় রয়েছে অসংখ্য মনোরম দর্শনীয় স্থান।
সুনামগঞ্জ জেলার আওতাধীন এই উপজেলার মোট আয়তন ৪৪০ বর্গকিলোমিটার। সীমান্তবর্তী এই উপজেলায় আছে বেশ কিছু নান্দনিক জায়গা। ছাতকের উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য। ১৩টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই ছোট্ট উপজেলাটি যুগ যুগ ধরে ভ্রমণপিয়াসু মানুষদের সৌন্দর্যতৃষ্ণা নিবারণ করে আসছে। ছাতকের সৌন্দর্যের বর্ণনা করতে গেলে প্রথমেই চোখের সামনে ভেসে উঠে ছাতকের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ইংলিশ টিলার ছবি। শতাব্দী প্রাচীন গল্পগাঁথা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই ইংলিশ টিলা। এর প্রকৃতি এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব সব বয়সের পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি ইংলিশ টিলার রয়েছে একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস। এই ইতিহাস মানুষের মুখে মুখে ফিরে এখন আমাদের জাতীয় জীবনের একটি অপরিহার্য সম্পদে পরিণত হয়েছে। জানা যায়, ১৭৯৪ সালে ইংল্যান্ড থেকে জর্জ ইংলিশ এসকুয়ার নামের এক ব্যবসায়ী ব্যবসার কাজে স্ত্রী কে নিয়ে ছাতক আসেন। এখানে আসার পর তিনি চুনাপাথরের ব্যবসা শুরু করেন। যা ছিলো ছাতকে সর্বপ্রথম চুনাপাথরের ব্যবসা। তার অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টার ফলে ছাতকে সম্ভাবনাময় চুনাশিল্পের বিপ্লব ঘটে।
জর্জ ইংলিশ ছাতকে দীর্ঘ ৫০ বছর ব্যবসা পরিচালনা করেন। দীর্ঘদিন এই এলাকাতে থাকার ফলে স্থানীয় মানুষজনও তাঁকে ভালোবাসতেন। তাঁর স্ত্রী হেনরী ছিলেন একজন মায়াবতী, দরদী নারী। তাঁরা দুজনই স্থানীয়দের ভালোবাসায় সিক্ত ছিলেন। ভালোবেসে হেনরীর স্বামীকে স্থানীয়রা ‘সাহেব’ ডাকতেন।
১৮৫০ সালে হটাৎ করেই ৭৬ বছর বয়সী জর্জ ইংলিশ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর স্ত্রী হেনরি স্বামীর ব্যবসা-বানিজ্য দেখাশোনা করতে শুরু করেন। স্বামীকে সমাহিত করে তার স্মৃতি ধরে রাখার পরিকল্পনা নেন হেনরী। ঐ বছরই হেনরি স্বামীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাগবাড়ী মৌজার টিলার উপর নির্মান করেন আকাশচুম্বি চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর স্মৃতিসৌধ। ২৫ ফুট উচ্চতা ও ৪ ফুট বর্গাকারের চওড়ার এই মিনারটির গায়ে মার্বেল পাথরে খোদাই করে লেখা আছে ইংলিশ দম্পতির ইতিহাস।
পরবর্তিতে এই স্মৃতিসৌধটি সাহেব মিনার হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে আর টিলাটির নাম হয়েছে ‘ইংলিশ টিলা’। এরপর থেকেই ইংলিশ টিলা ও সাহেব মিনারের গল্প ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। জর্জ-হেনরীর শ্বাশ্বত প্রেম ও পরস্পরের প্রতি ভক্তির কথা জানতে পেরে মানুষজন এখানে এসে তাদের শ্রদ্ধা জানান। ধীরে ধীরে পর্যটন এলাকায় রূপ নেয় টিলাটি।
কয়েকবছর পর জর্জ ইংলিশ এর স্ত্রী মিসেস হেনরি ব্যবসা-বাণিজ্য গুছিয়ে নিজ দেশে চলে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। ব্রিটিশরা শাসন গুটিয়ে নিয়ে চলে যাওয়ার পরে সরকার ইংলিশ টিলার মালিকানা করায়াত্ত্ব করে নেয়। এরপরই শুরু হয় অবহেলা আর অনাদর। নির্মাণের ১৭০ বছর অতিবাহিত হলেও খাঁটি নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার ও উন্নত ব্যবস্থাপনায় নির্মাণের কারণে এখনো অনেকটা অক্ষত আছে সাহেব মিনারটি। স্থানীয় প্রশাসনের নিকট উপজেলাবাসী দীর্ঘদিন যাবত ইংলিশ টিলাকে পিকনিক স্পটে পরিণত করার দাবি জানিয়ে আসছেন। তাঁরা বলছেন, প্রশাসন একটু আন্তরিক ও সচেষ্ট হলে গড়ে ইংলিশ টিলা হতে পারে ছাতকের পর্যটন শিল্পের অসাধারণ এক মাইলফলক।
আসাদুর রহমান ইজাজ, স্টাফ রিপোর্টার, সুনামগঞ্জ মিরর
সুনামগঞ্জমিরর/এআরআই/টিএম