ফজলুল হক আসপিয়াকে নিয়ে সাবেক ডিসি জাফর সিদ্দিকের স্মৃতিচারণ

সুনামগঞ্জের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ জনাব ‘ফজলুল হক আসপিয়া’ চিরবিদায় নিয়েছেন। বেশ কিছুদিন আগে ফেসবুকে তাঁরই একজন রাজনৈতিক অনুসারীর লেখায় অসুস্থতার খবরটি জেনেছিলাম।
সুনামগঞ্জে আমার কর্মকালে যে রাজনৈতিক নেতার সাথে সরকারি কাজে সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ রেখে চলতে হতো তিনি ছিলেন সেই ব্যক্তি। কারণ, একদিকে তিনি ছিলেন সদরের সরকারি দলের সাংসদ, জাতীয় সংসদের হুইপ এবং অপরদিকে (তৎকালীন সরকারি ব্যবস্থায়) ‘জেলার ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী’।
অত্যন্ত সহজ ও সরল মনের মানুষ ছিলেন তিনি।
সরকারি সকল কাজে তিনি সার্বিকভাবে আমাদের সহযোগিতা করতেন। তাঁকে কারও প্রতি বিদ্বেষ পোষন করতে দেখিনি। এমনকি বিরোধী দলের নেতাদের প্রতিও তিনি উদার মনোভাব পোষণ করতেন। যেমন, ধর্মীয় এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে বিপরীত মতের হলেও গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন কম্যুনিস্ট নেতা ‘বরুন রায়ে’র প্রতি। এ শ্রদ্ধা ছিল পারস্পরিক।
জেলা প্রশাসক হিসেবে কাজ করতে যেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই এ ব্যক্তিটির সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে যেয়ে আমি অনেক কাজ করেছি, যাতে তিনি সাময়িক মনোক্ষুণ্ণ হলেও কখনো স্থায়ী বিরুপতা পোষণ করেননি। কিংবা সরকারি কিংবা রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের নিকট কখনো কোন নালিশও উত্থাপন করেননি। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে আমার প্রতি কারো কোন অন্যায় সিদ্ধান্ত রোধে এমন দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন যে তাতে আমি অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছি।
২০০৪ এর বন্যায় আমরা প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন একাত্ম হয়ে কাজ করেছিলাম। সে কর্মযজ্ঞ ছিল ব্যাপক এবং বহুমুখী। এসব কাজে তিনি ছিলেন নিরলস এবং সবচেয়ে অগ্রণী। সুনামগঞ্জে সাড়ে তিন বছরে অসংখ্য ঘটনার স্মৃতি আজ আমার মানসপটে ভেসে আসছে। যার একটা বড় অংশ জুড়ে ছিলেন তিনি।
বন্যা অব্যবহিত পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সফরকালের একটি ঘটনা আমি এমুহুর্তে বিশেষভাবে স্মরণ করছি। যে ঘটনায় হুইপ মহোদয় আমাকে একটা অযাচিত হয়রানি থেকে বাঁচানোর জন্য নিজের রাজনৈতিক ক্ষতির ঝুঁকি নিতেও কুণ্ঠিত হননি।
সে সময়কার প্রচলন অনুযায়ী সার্কিট হাউসে আমি জেলার বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে প্রধামন্ত্রীকে ব্রিফিং প্রদান করছিলাম। তখন খুবই প্রাসঙ্গিক ভাবে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কথা উল্লেখ করেছিলাম, যারা প্রায় প্রতিদিন বন্যা পরিস্থিতির খোঁজ নিয়েছেন এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা কিংবা পরামর্শ দিয়েছেন। এতে একই অনুষ্ঠানে উপস্থিত তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্দ হন। কারণ, আমার আলোচনায় তাঁর (কিংবা তাঁর মন্ত্রণালয়ের) উল্লেখ ছিলনা। আলোচনায় আমি হুইপ মহোদয়ের নামও আমি উচ্চারণ করিনি। ব্রিফিং শেষ করে আমি যখন প্রধানমন্ত্রীর পেছনে দ্রুত বেরিয়ে আসছিলাম তখন কন্ফারেন্স রুম থেকে কেমন একটা একটা ক্ষুব্দ কন্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলাম, ”—-মন্ত্রীরা তার বাফ্ লাগেনি।” আমি শব্দটার উৎস এবং মর্মার্থ কোনটাই তাৎক্ষণিক পুরো উপলব্ধি করতে পারিনি। যারা নিকট থেকে প্রশাসনিক কোন কর্মকর্তাকে ভিভিআইপি’র প্রটোকল সামলাতে দেখেছেন কেবল তারাই অনুধাবন করতে পারেন সে সময়টায় অন্য আর কিছুতে মনোযোগ দেয়ার উপায় থাকেনা। ব্যাপারটা পরিস্কার বোধগম্য হলো প্রধানমন্ত্রীর হেলিকপ্টার আকাশে উড়ে যাবার দীর্ঘক্ষণ পর। ততক্ষনে অর্থমন্ত্রী মহোদয়ও চলে গেছেন মৌলভীবাজার কিংবা সিলেটে।
সার্কিট হাউসে ফিরে এসে দেখি হুইপ মহোদয় একা ভিভিআইপি রুমে বসে টেলিফোনে কার সাথে খুবই কাচুমাচু হয়ে কথা বলছেন। “না স্যার, না স্যার, উনি আওয়ামী লীগ না, বিএনপিও না। না স্যার, উনি আওয়ামী না, উনি নিরপেক্ষ।’ কিন্তু ওপারে যিনি আছেন, মনে হচ্ছে তিনি কিছুতেই নিরস্ত হচ্ছেন না।
আমি একটু এগিয়ে গিয়ে হুইপ মহোদয়কে বললাম, “স্যার, আপনি দয়া করে আমার জন্য জবাবদিহি করা বন্ধ করুন। উনাকে পছন্দমতো যা কিছু করতে দিন। আমার কোন সমস্যা নেই। আপনি রাজনীতি করেন। আমাকে রক্ষা করতে যেয়ে আপনি কেন অযথা হয়রানি হবেন।”
তিনি টেলিফোনে হাত চাপা দিয়ে আমাকে হাতের ইশারা এবং ভ্রুকুটি করে চুপ থাকতে বললেন। আমি ভগ্ন মনে সার্কিট হাউস থেকে বের হয়ে আসলাম। অথচ সে যাত্রায় কিংবা পরে আমার প্রতি মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বিরুপ কোন তৎপরতা টের পাইনি।
টাঙ্গুয়ার হাওর সংরক্ষণে তিনি ছিলেন প্রশাসনের সবচেয়ে বড় সমর্থক এবং সহায়ক শক্তি। ম্যাজিস্ট্রেসিকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে যে বিষয়টি আমি সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করেছি তা ছিল উদারতা। যার ব্যাপক প্রভাব ছিল জেলার রাজনৈতিক অঙ্গনে। সরকারি কাজে এর সুফল পেয়েছে অনেকেই; প্রশাসন, পুলিস, জুডিশিয়ারি —জনগণ সবাই।
জনাব ফজলুল হক আসপিয়া বিদায় নিয়েছেন। তার বিয়োগে আমি সবচেয়ে ব্যথিত হচ্ছি এই ভেবে যে আমি তাঁর ছোট-বড় অনেক অনুরোধই রক্ষা করতে পারিনি। যা একজন সক্রিয় রাজনীতিবিদ সচরাচর আশা করে থাকেন।
তিনি একজন সফল রাজনীতিবিদ হিসেবে দীর্ঘ সফল জীবনের অধিকারী ছিলেন। তাই, তাঁর এই তিরোধান খুব অপ্রত্যাশিত কিংবা অসময়োপযোগী ছিল তা নয়। কিন্তু আমি তাঁর বিদায়ে তীব্র বেদনা অনুভব করছি। একজন গভীর প্রেরণাদায়ক প্রিয় মানুষের চিরবিদায়ে যা হয়।
হে মহান আসপিয়া -যেখানেই থাকুন, ভাল থাকুন। সৃষ্টিকর্তার নিরবচ্ছিন্ন কৃপা লাভ করুন আপনি। যার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল আপনার।
জাফর সিদ্দিক
অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম-সচিব; সাবেক জেলা প্রশাসক, সুনামগঞ্জ