শুভ জন্মদিন বাদশাহ নামদার

আজ গল্পের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদের ৭৪তম জন্মদিন। হুমায়ুন আহমেদ বিংশ শতাব্দীর বাঙালি জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম। তাঁকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী শ্রেষ্ঠ লেখক গণ্য করা হয়। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার নাট্যকার এবং গীতিকার। বলা হয় আধুনিক বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের তিনি পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি সমাদৃত। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতাধিক।
বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপপ্রধান নতুন শৈলীর জনক। তাঁর বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বেশ কিছু গ্রন্থ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সত্তর দশকের শেষ থেকে শুরু করে মৃত্যু অবধি তিনি ছিলেন বাংলা গল্প উপন্যাসের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কারিগর। এই কালপর্বে তাঁর গল্প-উপন্যাসের জনপ্রিয়তা ছিল তুলনারহিত। তার সৃষ্ট হিমু ও মিসির আলি চরিত্রগুলি বাংলাদেশের যুবক শ্রেণীকে গভীরভাবে উদ্বেলিত করেছে। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রসমূহ পেয়েছে অসামান্য দর্শকপ্রিয়তা। তবে তাঁর টেলিভিশন নাটকগুলি ছিল সর্বাধিক জনপ্রিয়। সংখ্যায় বেশী না হলেও তাঁর রচিত গানগুলি বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
হুমায়ূন আহমেদের নাম শোনেননি এমন মানুষ বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বাংলা সাহিত্য, নাটক এবং চলচ্চিত্র, প্রতিটি ক্ষেত্রেই হুমায়ূন আহমেদের নাম সবার শীর্ষে। বাংলা সাহিত্য শরৎচন্দ্রের পরে সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যিক বলা হয় তাঁকে। চলুন আজকে একটু ঘুরে আসি হুমায়ূনের ভুবন থেকে!
হুমায়ূন আহমেদের জন্ম হয় ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোণা জেলায়। তাঁর বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা এবং মা আয়েশা ফয়েজ গৃহিনী। আয়েশা ফয়েজ তাঁর ‘জীবন যে রকম’ বইটিতে হুমায়ূনের ছোটবেলার কথা তুলে ধরেছেন। হুমায়ূন ছিলেন বাবা মায়ের প্রথম সন্তান। তাঁর বাবার খুব শখ ছিলো মেয়ে হবে, কিন্তু ছেলে হওয়াতেও তিনি খুশি ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদের নানা অনেক অবস্থা সম্পন্ন ছিলেন। তাই প্রথম নাতির জন্ম উপলক্ষ্যে মণ খানেক মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন। ছোট্ট হুমায়ূন দেখতে টকটকে ফরসা এবং সুন্দর ছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদের বাবার চাকরির সুবাদে তাঁর ছেলেবেলা কাটে সিলেটের মিরাবাজারে। সেখানে কিশোরি মোহন পাঠশালা স্কুলে শুরু হয় তার শিক্ষাজীবন। হুমায়ূন ‘আমার ছেলেবেলা’ বইটিতে তুলে ধরেছেন তাঁর প্রথম স্কুল জীবনের কথাগুলো। অত্যন্ত মেধাবি হুমায়ূন একবার পড়লেই কোনো কিছু মুখস্ত করে ফেলতে পারতেন। তাঁর জীবন কেটেছে অনেকটা খামখেয়ালি আর আবেগ দিয়ে। প্রাইমারি স্কুলে থাকতেই তিনি ছোট আরেকটি মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দেন। বলাই বাহুল্য, তাঁর কপালে তখন উত্তম মধ্যম জুটেছিলো।
আমরা আজকে যে হুমায়ূন আহমেদকে দেখি, তিনি একদিনে তৈরি হননি। তাঁর জীবন তাঁকে প্রতিটি পদে কষ্ট দিয়েছে, অভিজ্ঞতা দিয়ে সমৃদ্ধ করেছে। হুমায়ূন আহমেদ পড়াশোনার পাশাপাশি ছবি আঁকাতেও পারদর্শী ছিলেন। তাঁর বাবা ছেলেমেয়েদের কবিতা আবৃত্তি করতে দিতেন। ভালো হলে পুরস্কার দিতেন। ফলে, সাহিত্যের সাথে তাঁর পরিচয় ছোট থেকেই বলা যায়।
মেট্রিক এবং আই এ পরীক্ষায় হুমায়ূন বোর্ডের মধ্যে স্ট্যান্ড করেছিলেন। পরে ভর্তি হোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর জীবন খুবই অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলো। তাঁর বাবা যদিও তখন পুলিশে চাকরি করতেন, কিন্তু মিলিটারিরা তাকে মেরে ফেলে। আয়েশা ফয়েজ সেই কঠিন সময়টার কথা তাঁর “জীবন যে রকম” বইয়ে লিখেছেন। যুদ্ধের সময় ঘরবাড়ি হারা হয়ে তাঁদেরকে অনেকদিন মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে।ছয় ভাই বোন নিয়ে তাঁর মা তখন অকূল পাথারে।
যুদ্ধের পরে হুমায়ূন আহমেদের পরিবার ঢাকায় শহীদ পরিবার হিসেবে একটা বাসায় উঠেন।কিন্তু সে অভিজ্ঞতা সুখকর ছিলো না। বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার হুমকি, চুরি ইত্যাদি ছিলো নিত্যদিনের সঙ্গী। একবার তাদের বাসায় এমন ভাবে চুরি হয় যে তাঁর বোন শিখুকে বিয়ের শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াতে হয়েছিলো। খামখেয়ালি হুমায়ূন তখন গুলতেকিন নামের একজন মেয়ের প্রেমে পড়েন। মেয়েটি ক্লাস টেনে পড়ে। সেই প্রেম ছিলো অনেকটা নাটকের মতো। প্রেমের কিছু দিনের মধ্যেই বিয়ে করলেন তাকে।তখনো তাদের থাকার মতো ঘর নেই, আসবাব নেই!
হুমায়ূন আহমেদ চাকরি জীবন শুরু করেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। অল্প বেতনে এতো বড় সংসার চলতো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি থার্মোডাইনামিক্স এবং কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স পড়াতেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি খুব জনপ্রিয় ছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে” প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। বইটি প্রথম দিকে একেবারেই চলে নি। পরে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরি বইটির প্রচ্ছদ করে দেন, জনপ্রিয়তা পায় এবং সমালোচকেরা তখনই বুঝতে পারেন বাংলা সাহিত্যে এমন কেউ আসছেন যিনি পরবর্তী বছর গুলোতে রাজত্ব করবেন। একে একে তাঁর ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ‘অচিনপুর’ বইগুলো প্রকাশিত হতে থাকে। তিনি পেতে থাকেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। আগেই বলেছি, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন খামখেয়ালি। হঠাৎ করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দেন। বিদেশে ছিলেন প্রায় পাঁচ বছর। তখনো তাঁর সাহিত্য চর্চা থেমে থাকেনি। হুমায়ূন আহমেদের কিন্তু ডক্টরেট ডিগ্রি আছে, কিন্তু তিনি ড. হুমায়ূন আহমেদ লিখতে খুব অপছন্দ করতেন।
এরপরের গল্পগুলো খুব সুন্দর। হুমায়ূন আহমেদের বই গুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। তাঁর সৃষ্ট হিমু, মিসির আলী, শুভ্র, রূপা চরিত্রগুলো মানুষের হৃদয় জয় করে নেয়। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বিটিভির প্রযোজক মুস্তাফিজুর রহমানের উৎসাহে তিনি নাটক বানানো শুরু করেন। তাঁর প্রতিটি নাটক এতোটাই জনপ্রিয় হয় যে, এক সময় মানুষ টিভির সামনে আসতোই তাঁর নাটক দেখার জন্য। ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘আজ রবিবার’, ‘বহুব্রীহি’ ইত্যাদি তাঁর কালজয়ী নাটক। বাকের ভাই আর মুনার চরিত্র এখনো মানুষের মুখে মুখে ফিরে।

‘আগুনের পরশমনি’ ছবি দিয়ে তিনি চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক এই ছবি জাতীয় পুরস্কার পায়। এরপর ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র মতো ছবি বানিয়েছেন তিনি। আর হুমায়ূন আহমেদের প্রতিটি ছবিই বাংলাদেশের জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে।
সর্বশেষ ছবি ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ ২০১৩ সালে অস্কারে পাঠানোর জন্য মনোনীত হয়েছিলো।
হুমায়ূন আহমেদ নন্দন কানন নুহাশ পল্লীকে তাঁর স্বপ্নের মতো করে গড়ে তোলেন। সেখানে রয়েছে অজস্র দুর্লভ গাছ, প্রতিকৃতি, অনেকগুলো পুকুর। বৃষ্টির গান শোনার জন্য রয়েছে আলাদা ‘বৃষ্টি বিলাস’। হুমায়ূন আহমেদ ম্যাজিক বিদ্যা, মহাকাশে গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান, গ্রামীণ নানা সংস্কার সম্পর্কে খুব জ্ঞানী ছিলেন। ২০০০ সালে গুলতেকিনের সাথে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এতে তাঁর পরিবারের সদস্যরা এতোটাই ক্ষুব্ধ হোন যে পরের কয়েক বছর তাঁকে একাকী কাটাতে হয়। ‘এলেবেলে’ বইয়ে তিনি এ ঘটনা লিখেছেন। কয়েক বছর পরে তিনি অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন। আমৃত্যু শাওন তাঁর পাশে ছিলেন। জীবনানন্দ দাশ হুমায়ূনের প্রিয় কবি। জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থ একরাতে বাজি ধরে মুখস্ত করেছিলেন তিনি।
হুমায়ূন আহমেদ চেয়েছিলেন জোছনা রাতে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেন। সৃষ্টিকর্তা এমনটি চাননি হয়তো। আমেরিকার বেলভিউ হাসপাতালে ১৯ জুলাই ২০১২ সকাল সাড়ে এগারোটার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি দীর্ঘদিন কোলন ক্যানসারে ভুগছিলেন।
তিনি চেয়েছিলেন নুহাশ পল্লীতে তাঁকে সমাহিত করা হবে। সেটাই করা হয়েছে। লিচু তলায় হুমায়ূনের কল্পনার মতো, শুভ্র সমাধি ফলকের উপরে লেখা রয়েছে,
“চরণ ধরিতে দিও গো আমারে,
নিও না, নিও না সরায়ে…!”
▪️মুয়াজ্জাজুর রহমান মুয়াজ
সুনামগঞ্জমিরর/এসএ