হাসপাতালে দালাল চক্রের টার্গেটে থাকে গ্রামের রোগী

আব্দুল হান্নান ও হাসিনা বেগমের একমাত্র মেয়ে রাফিয়া বেগম (০৬)। বাড়ি সুনামগঞ্জের দোয়ারা বাজার উপজেলার মান্নার গাঁও ইউনিয়নের করিমপুর গ্রামে। শিশু রাফিয়া বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে পড়ে ডান হাতে আঘাত পায়। সেজন্য ১০ জানুয়ারি সকালে সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সদর হাসপাতালে মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে আসেন বাবা-মা। কিন্তু হাসপাতালের মূল গেটে ডুকতেই আয়া ও ওয়ার্ডবয়ের যোগসাজশে দালাল চক্রের খপ্পরে পড়েন তারা।
‘হাসপাতালে ভালো হাঁড় ভাঙার ডাক্তার নেই’ বলে তাদের উন্নত চিকিৎসার প্রলোভন দেখিয়ে পৌর শহরের উকিলপাড়া নিউ নিরাময় ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। শুধু আব্দুল হান্নান ও হাসিনা বেগম নয় প্রতিদিন গ্রাম থেকে উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার আশায় আসা শতাধিক রোগীকে এ দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে ব্যয় করতে হচ্ছে দ্বিগুণ টাকা। অথচ সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে খরচ হতো মাত্র ৫ টাকা।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, দালালেরা প্রথমে নিজেদের হাসপাতালের কর্মী হিসেবে পরিচয় দেয়। হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার কথা বলে রোগী ও স্বজনদের উন্নত চিকিৎসার প্রলোভন দেখিয়ে প্রাইভেট ডায়গনস্টিক সেন্টারে নেওয়ার চেষ্টা করে। শুধু তাই নয় হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের কৌশলে জানিয়ে দেয় হাসপাতালের চিকিৎসা সামগ্রী অচল ও নিম্নমানের। ভুল রিপোর্ট আসে। এসব বলে তাদেরকে প্রভাবিত করে ক্লিনিকে ও ডায়গনস্টিক সেন্টারে নিয়ে গিয়ে প্রাইভেটে ডাক্তার ও পরীক্ষা করে মোটা অংকের কমিশন হাতিয়ে নেয় এই চক্রটি।
দালাল চক্রের খপ্পড়ে পড়া আব্দুল হান্নান ও হাসিনা বেগম বলেন, খেলতে গিয়ে আমার মেয়েটি হাতে আঘাত পায়। ডাক্তার দেখানোর জন্য মেয়েকে যখন হাসপাতাল নিয়ে গেলাম তখন হাসপাতালের আয়া ও ওয়ার্ড বয় বলে ‘এখানে হাঁড় ভাঙার ডাক্তার পাবেন না, হাসপাতালে ডাক্তার সংকট ও রিপোর্ট ভুল দেয়। আপনাদের ভালোর জন্য বলছি আপনারা পৌর শহরের উকিলপাড়া নিউ নিরাময় ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ডা. সাবিরুল ইসলামের কাছে যান খুব ভালো ডাক্তার।’
আমরা উনাকে চিনি না বললে পারভেজ নামের এক রিকশাচালক দিয়ে তারা আমাদের সেখানে পাঠিয়ে দেয়।
তারা আরো বলেন, সেই ডাক্তার আমার মেয়েকে দেখার পর এক্স-রে ও রক্ত পরীক্ষা দিলেন এবং সেটা ইউনিক ডায়গনস্টিক সেন্টারে গিয়ে করতে বলেন। আমরা তার কথামতো সেখানে গিয়ে পরীক্ষা করালে আমার মেয়ের হাতের হাঁড় ভেঙে গেছে বলে এক্স-রে রিপোর্ট আসে কিন্তু ডাক্তার সেই রির্পোট দেখেও তাকে প্লাস্টার না করার পরার্মশ দিয়ে খাওয়ার ওষুধ দিয়ে দেন এবং এক সপ্তাহ পর আবার আসতে বলেন। একসপ্তাহ পর আজ আবার তার কাছে আসলে উনি বলেন, হাসপাতালে গিয়ে হাতে প্লাস্টার করেন। আমি কিছু করতে পারব না। এই বলে তিনি ভিজিট রেখে দেন।
তারা আরো বলেন, আমার মেয়ের হাত এতদিনে ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তারা সেটা করতে দিলো না।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রেখা আক্তার বলেন, একসপ্তাহে আগে আমি দাঁতের সমস্যার জন্য এসেছিলাম। কিন্তু হাসপাতালের পোশাক পরা একজন পুরুষ ও এক নারী বলেন হাসপাতালে ভালো দাঁতের ডাক্তার নেই। আমি বুঝতে পেরেছি তারা দালাল। পরে আমি চুপ করে তাদের কাছ থেকে চলে গেছি। আমার কর্তৃপক্ষের কাছে একটা অনুরোধ দ্রুত যাতে হাসপাতাল দালালমুক্ত করা হয়।
হাসপাতাল রোডের এক ফার্মেসি ব্যবসায়ী লিটন মিয়া (ছদ্ননাম) বলেন, প্রতিদিন সকাল হলে হাসপাতালের মূল গেটে দালালদের উপদ্রব বেড়ে যায়। তারা মূলত গ্রামের অসহায় মানুষকে টার্গেট করে।
সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের অর্থপেডিক সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. শ্যামল চন্দ্র বর্মণ বলেন, এক্স-রেতে যদি কোনো শিশুর হাঁড় ভেঙে যায় তাহলে সেটা দ্রুত প্লাস্টার করতে হবে। দেরি হয়ে গেলে শিশুটির হাত পুরোপুরি সোজা হবে না।
নিরাময় ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চিকিৎসক ডা. সাবিরুল ইসলাম বলেন, শিশুটির হাত ভেঙে গেছে। সেজন্য ব্যথা কমাতে আমি ওষুধ দিয়েছি। বলেছি এক সপ্তাহ পর আসতে। শিশুটির ব্যথা কমেনি, তাই আজ প্লাস্টার করার জন্য হাসপাতালে পাঠিয়েছি।
সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আনিসুর রহমান বলেন, হাসপাতালের চারদিকে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। রোগীদের দালালের খপ্পরে পড়ার সুযোগ নেই। তবে হাসপাতালের বাইরে যদি দালালদের প্রতরণায় রোগীরা পড়ে সেক্ষেত্রে আমার কিছু করার নেই।
তিনি বলেন, আমি হাসপাতালে সেবা নিতে আসা সকলকে অনুরোধ করবো দালালদের প্রতারণায় কেউ পড়বেন না।
লিপসন আহমেদ/সুনামগঞ্জমিরর/এসএ