ভয়াবহ বন্যার কবলে সুনামগঞ্জ, ক্রমেই বাড়ছে পানির স্রোত
টানা ভারী বৃষ্টিপাত আর উজানের ঢলে ডুবেছে সুনামগঞ্জ। বৃষ্টির সাথে ঝড়ো হাওয়া ও বজ্রপাতেরও যেন বিরাম নেই। সময়ের সাথে সাথে বন্যা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। প্রতিমুহূর্তে বাড়ছে বানের জলের উচ্চতা। বাসাবাড়ির ভেতরে পানি প্রবেশ করেছে আগেই। ইট, কাঠসহ নানা জিনিস ব্যবহার করে অনেকেই তাদের ঘরে শোবার খাটটি উঁচু করার চেষ্টা করেছেন, সেই খাটও তলিয়ে গেছে পানিতে। বন্যার পানির সঙ্গে ঘরে ঢুকে পড়ছে মাছ, বিষাক্ত পোকামাকড় ও সাপ। অন্যদিকে দুর্ঘটনা এড়াতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রেখেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। ফলে অন্ধকার রাতে বিভীষিকাময় সময় পার করেছেন সুনামগঞ্জের মানুষ।

বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) সন্ধ্যা থেকেই সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। এসময় সারাদেশের সঙ্গে সুনামগঞ্জের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
গত এপ্রিলে সিলেট অঞ্চলের নিম্নাঞ্চলে অসময়ে বন্যা দেখা দেয়। এরপর মে মাসের মাঝামাঝিতে সময়ে বিগত ১৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়। সুনামগঞ্জে প্রথম দফা বন্যা হয় গত ১৩ মে। এই বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই ফের বন্যার কবলে পড়েছে সুনামগঞ্জের বাসিন্দারা। দ্বিতীয় দফা বন্যায় এখন শহরের সড়কে চলছে নৌকা। বিদ্যুৎ না থাকায় চার্জের অভাবে মুঠোফোনও বন্ধ হয়ে আছে অনেকের। কারো কারো ঘরে খাবার নেই, রান্নাঘর ডুবে যাওয়ায় আগুন জ্বলছে না চুলায়। সবমিলিয়ে বানের জলে দুঃস্বপ্নের রাত কাটিয়েছেন জেলাবাসী। যে কয়টি ঘরে পানি ওঠা বাকি ছিল, সেগুলোও এখন পানিতে থইথই।

সুনামগঞ্জ শহরের উত্তর আরপিননগর, তেঘরিয়া, বড়পাড়া, মধ্যবাজার, কাজির পয়েন্ট, হাসন নগর, জগন্নাথবাড়ি রোড, নতুনপাড়া, উকিল পাড়া, ষোলঘর, নবীনগর এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে আগেই। ক্রমেই পানির স্রোত বাড়ছে। বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) সকাল থেকেই পানি বাড়তে থাকায় অনেকেই বাসা থেকে বের হতে পারেননি। জরুরি প্রয়োজনে যারা বের হয়েছেন তাদের প্রায় সকলকেই কোমর পানি মাড়িয়ে চলাচল করতে হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে চাকরিজীবী ও স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা দাবি করেছেন, সুনামগঞ্জকে বন্যা দুর্গত এলাকা ঘোষণা করে যেন সাধারণ ছুটি দেওয়া হয়। এসএসসি পরীক্ষা পেছানোরও দাবি উঠেছে।

বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ও মারাত্মকভাবে বন্যাকবলিতদের সহায়তায় উদ্ধার কাজ চালাতে সেনাবাহিনী মোতায়েনেরও দাবি জানাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সুনামগঞ্জ শহরের হাসননগরের বাসিন্দা শফিকুজ্জামান চৌধুরী সজীব এই প্রতিবেদককে বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা প্রয়োজন। তা না হলে এই দুর্যোগ মোকাবেলা করা যাবে না। একই মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ওবায়দুল হক। তিনি বলেন, সুনামগঞ্জের সাধারণ মানুষ আগে কখনো এমন বিপর্যয়ে পড়েননি। তারা ধারণাও করতে পারছেন না পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবেন। পরিবার-পরিজন, ঘরবাড়ি ও গবাদিপশু সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন অনেকে। ঘরে পানি ওঠায় খাটের উপর চেয়ার তুলে চেয়ারে বসে রাত কাটাচ্ছেন। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে উদ্ধার ও ত্রাণসহায়তা বিতরণ কাজ পরিচালনা করা ছাড়া অন্যদের পক্ষে এই পরিস্থিতি সামলে ওঠা কঠিন হবে।
পৌর এলাকার ময়নার পয়েন্টের বাসিন্দা হাবিবুস সামাদ বলেন, আমাদের আশপাশে এমন কোনো বাসাবাড়ি নেই, যাদের ঘরে পানি ঢোকেনি। হাসন নগর এলাকার বাসিন্দা শিক্ষিকা মতিয়া চৌধুরী বলেন, বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে অসুবিধায় পড়তে হয়েছে। ঘরের ভেতর পানি ঢুকে সব আসবাবপত্র তলিয়ে গেছে। ঘরের ভেতরে ও বাইরে সবজায়গায় পানি। এরমধ্যে রয়েছে সাপ ও পোকামাকড়ের উপদ্রবের ভয়। সবমিলিয়ে আমরা আতঙ্কে আছি।

সুনামগঞ্জ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ তাদের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সেসময় বলা হয়, ছাতক গ্রীড উপকেন্দ্রে সুনামগঞ্জের ১৩২ কেভি মেইন লাইনের ব্রেকারে কাছাকাছি চলে এসেছে পানি। পানিতে তার, খুটি বা মিটার খুলে পড়ে থাকতে দেখলে তা হাত দেওয়া থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিপদজনক কিছু দেখলে বা দূর্ঘটনার আশঙ্কা করলে ০১৭১৪০৬৯৩৭৭ নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
কয়েকজন স্থানীয় সাংবাদিক জানান, বিদ্যুৎ না থাকার কারণে তারা সংবাদ পাঠাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। অনেকের মোবাইলেও চার্জ নেই। তাছাড়া ঘরে পানি ওঠায় নিজেদের পরিবার নিয়েই তারা বিপাকে আছেন।
গত বুধবার (১৫ জুন) সুনামগঞ্জের ছাতক-গোবিন্দগঞ্জ সড়ক ও সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়কের বিভিন্ন স্থান প্লাবিত হওয়ায় ছাতক ও তাহিরপুর উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সুরমা নদীর তীর উপচে জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বন্যার পানি প্রবেশ করে। ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলা পুরোটাই বন্যাকবলিত। ছাতক উপজেলায় ছয়টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। জেলার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ইতোমধ্যেই সহস্রাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যায় কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) সাংবাদিকদের জানান, ‘আবহাওয়া অফিসের দেওয়া তথ্যে সুনামগঞ্জে আরও ২ দিন বৃষ্টিপাত থাকবে, এ সময় বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে।’ সন্ধ্যা থেকে বিরমাহীন বৃষ্টি হচ্ছে সুনামগঞ্জে, যাতে পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জে সুরমার পানি বিপৎসীমার ৭৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় মেঘালয়ে প্রায় সাড়ে ছয়শ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। পাহাড়ি ঢলে আগামী ৭২ ঘণ্টায় সুরমায় পানি বাড়তে পারে। এমনটা ঘটলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে।
সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত জানান, বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) সুনামগঞ্জ পৌর শহরের সব একতলা বাড়ি প্লাবিত হয়েছে। প্রতিটি গলিতে এখন নৌকা চলছে। একতলা বিশিষ্ট দোকানপাট প্লাবিত হয়ে নিত্যপণ্য ও ওষুধসহ নানা পণ্যের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। মানুষ উঁচু ভবন খুঁজে খুঁজে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে। ভয়াবহ দুর্যোগে পড়েছেন সুনামগঞ্জের মানুষ।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, দেশের সব প্রধান নদ-নদীসমূহের পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবহাওয়া সংস্থাসমূহের গাণিতিক মডেলভিত্তিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী সোমবার নাগাদ দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয় ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গের কতিপয় স্থানে মাঝারি থেকে ভারী কোথাও কোথাও অতিভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। ফলে আগামী শনিবার নাগাদ ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, সুরমা, কুশিয়ারা, তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমারসহ সকল প্রধান নদ-নদীসমুহের পানির সমতল বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে।
বিভিন্ন পূর্বাভাস বলছে, শুক্রবার (১৭ জুন) নাগাদ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণা জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। এই সময়ে তিস্তা নদীর পানির সমতল বিপৎসীমার উপরে অবস্থান করতে পারে। বর্তমানে সুনামগঞ্জে সুরমার পানি বিপৎসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পর্যবেক্ষণাধীন বিভিন্ন নদ-নদীর ১০৯টি পয়েন্টের মধ্যে পানির সমতল বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) বেড়েছে ৮৬টিতে, কমেছে ২০টিতে, অপরিবর্তিত আছে তিনটি পয়েন্টের পানির সমতল। আর পাঁচটি পয়েন্টে পানির সমতল প্রবাহিত হচ্ছে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে।

এদিকে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় বন্যা মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিয়েছে প্রশাসন। ইতোমধ্যে বন্যাকবলিত এলাকায় জরুরি ত্রাণসহায়তা পাঠাতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক। জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন জানিয়েছেন, ১২টি উপজেলায় ইতোমধ্যে ২০ মেট্রিকটন করে খাদ্যসামগ্রী বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
গত মে মাসের বন্যাকে ২০০৪-এর বন্যার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন অনেকে। ১৮ বছর আগে আরেক ভয়াবহ বন্যার স্বাক্ষী হয়েছিল সুনামগঞ্জ, সেবার শহরের প্রায় সব আবাসিক এলাকার ঘরবাড়ি ডুবে গিয়ে ঘোর সঙ্কটে পড়েন জেলাবাসী। তবে এবারের বন্যা যেন ২০০৪-এর বন্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করছেন বয়োবৃদ্ধরা। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদেরও সহায়তা কার্যক্রমে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন অনেকে।