সুনামগঞ্জকে ‘বন্যাদুর্গত এলাকা’ ঘোষণা করে উদ্ধারকাজে সেনা মোতায়েনের দাবি

টানা ভারী বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের ফলে সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। জেলা সদরের বিভিন্ন এলাকার ঘরবাড়ির ভেতরে পানি প্রবেশ করেছে। পানির উচ্চতা ক্রমশ বাড়তে থাকায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। শহরের অধিকাংশ বাসাবাড়ির ভেতর কোমরসমান পানি উঠেছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় এই উচ্চতা বেড়েই চলেছে। পানিবন্দী হয়ে আছেন লাখো মানুষ। এ অবস্থায় বন্যাকবলিতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী মোতায়েন ও জরুরি অবস্থা ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন অনেকে।
বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) সন্ধ্যা থেকেই সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। সারাদেশের সঙ্গে সুনামগঞ্জের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর আগে সুনামগঞ্জে প্রথম দফা বন্যা হয় গত ১৩ মে। এবার দ্বিতীয় দফা বন্যায় শহরের সড়কে চলছে নৌকা। বিদ্যুৎ না থাকায় চার্জের অভাবে মুঠোফোনও বন্ধ হয়ে আছে অনেকের। কারোর ঘরে খাবার নেই, রান্নাঘর ডুবে যাওয়ায় আগুন জ্বলছে না চুলায়। ইট, কাঠসহ নানা জিনিস ব্যবহার করে অনেকেই তাদের শোবার খাটটি উঁচু করার চেষ্টা করেছেন, সেই খাটও তলিয়ে গেছে পানিতে। বন্যার পানির সঙ্গে ঘরে প্রবেশ করছে মাছ, বিষাক্ত পোকামাকড় ও সাপ। সবমিলিয়ে বানের জলে দুঃস্বপ্নের রাত কাটিয়েছেন জেলাবাসী। যে কয়টি ঘরে পানি ওঠা বাকি ছিল, সেগুলোও এখন পানিতে থইথই।
শুক্রবার (১৭ জুন) সকালে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সুনামগঞ্জের শিক্ষার্থীরা। নিজেদের পরিবারের সদস্যদের সহ এলাকার বন্যাকবলিতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার দাবি জানান তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আয়েশা সিদ্দিকা জানান, শহরের ষোলঘরে নদীতীরবর্তী এলাকায় তাদের বাড়ি। ঘরের ভেতরে বানের পানির উচ্চতা কোমরের চেয়ে উঁচুতে। এ অবস্থায় জরুরিভিত্তিতে তার পরিবারের সদস্যদের উদ্ধারে সহায়তা প্রয়োজন। কিন্তু তিনি কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল করলেও সকল এজেন্ট ব্যস্ত আছেন বলে জানাচ্ছে আন্সার মেশিন। এলাকার কাউকে মোবাইলে কল করেও সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাপসী দে প্রাপ্তি জানান, সুনামগঞ্জ শহরের দক্ষিণ নতুনপাড়ায় তাদের ঘরের ভেতরে পানি বাড়ছে। বাবা-মা সেখানে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। এভাবে চলতে থাকলে তারা আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারেন বলে আশঙ্কা করেন প্রাপ্তি। তিনি বলেন, ‘জানতে পেরেছি বিভিন্ন এলাকায় অনেকে এমনভাবে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন যে, দ্রুত উদ্ধার করা সম্ভব না হলে তারা মারা পড়বেন। এখন বাবা-মাকে নিয়ে খুব ভয় হচ্ছে। এই ভয়টা কেউ বুঝবে না।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হামিদুর রহমান বলেন, ‘গণমাধ্যমে এখনও সুনামগঞ্জের পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে প্রতিবেদন চোখে পড়ছে না। সম্ভবত স্থানীয় সাংবাদিকরাও বন্যাকবলিত হয়ে বিপদে আছেন। তারা খবর পাঠাতে পারছেন না। কিন্তু গণমাধ্যমে খবর না এলে তো এই পরিস্থিতির ব্যাপারে সবাই নজর দেবে না। সেখানকার প্রকৃত অবস্থা বাইরে থেকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।’ পরে এই প্রতিবেদককে এ ব্যাপারে প্রতিবেদন প্রকাশের অনুরোধ জানান তিনি।
গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওবায়দুল হক বলেন, সুনামগঞ্জের সাধারণ মানুষ আগে কখনো এমন বিপর্যয়ে পড়েননি। তারা ধারণাও করতে পারছেন না পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবেন। পরিবার-পরিজন, ঘরবাড়ি ও গবাদিপশু সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন অনেকে। ঘরে পানি ওঠায় খাটের উপর চেয়ার তুলে চেয়ারে বসে রাত কাটাচ্ছেন। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে উদ্ধার ও ত্রাণসহায়তা বিতরণ কাজ পরিচালনা করা ছাড়া অন্যদের পক্ষে এই পরিস্থিতি সামলে ওঠা কঠিন হবে।
এর আগে বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) রাতে সুনামগঞ্জ ও সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহতা প্রসঙ্গে স্ট্যাটাস দেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জফির সেতু। তিনি বলেন, ‘রাতেই সেনাবাহিনী নামানো প্রয়োজন। পরিস্থিতি ভয়াবহ দিকে যাচ্ছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জ তলিয়ে যাচ্ছে। পানিবন্দী মানুষকে এখনই উদ্ধার কাজের উদ্যোগ নিতে হবে।’
শুক্রবার (১৭ জুন) সকাল ৭টার দিকে সুনামগঞ্জ থেকে আম্মার আহমেদ নামের একজন স্বেচ্ছাসেবক জানান, প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করেও ভোর ৫টায় তিনি ও তার এক বন্ধু নৌকা নিয়ে উদ্ধার কাজে বের হয়েছিলেন। খবর পেয়েছেন একজন বৃদ্ধ নারী পানিবন্দী, যার ঘরে প্রায় বুকসমান উচ্চতায় পানি প্রবেশ করেছে। ওই নারীকে উদ্ধারের সময় একদল স্থানীয় ব্যক্তি তার নৌকাটি মিনিট দশেকের জন্য চেয়ে নেন। দুইঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও তারা আর ফেরত আসেননি। এতে আম্মার এখন নিজেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে পানিতে আটকে পড়েছেন। প্রচণ্ড স্রোতের কারণে নড়াচড়া করতে পারছেন না, শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে। আশপাশে অন্যকোনো স্বেচ্ছাসেবী দল বা সংস্থা বা ব্যক্তিও তার চোখে পড়েনি। এখন সেনাবাহিনীর মতো চৌকস বাহিনী দায়িত্ব না নিলে গভীর দুর্যোগে পড়তে হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) রাতে সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার ময়নার পয়েন্টের বাসিন্দা হাবিবুস সামাদ বলেন, আমাদের আশপাশে এমন কোনো বাসাবাড়ি নেই, যাদের ঘরে পানি ঢোকেনি। হাসন নগর এলাকার বাসিন্দা শিক্ষিকা মতিয়া চৌধুরী বলেন, বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে অসুবিধায় পড়েছি। ঘরের ভেতর পানি ঢুকে সব আসবাবপত্র তলিয়ে গেছে। ঘরের ভেতরে ও বাইরে সবজায়গায় পানি। এরমধ্যে রয়েছে পোকামাকড়ের উপদ্রবের ভয়। সবমিলিয়ে আমরা আতঙ্কে আছি। একই এলাকার বাসিন্দা শফিকুজ্জামান চৌধুরী সজীব বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা ছাড়া এই দুর্যোগ মোকাবেলা করা যাবে না। জরুরিভিত্তিতে উদ্ধার কাজ শুরু করতে হবে।
এদিকে বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) রাত থেকে দীর্ঘসময় ধরে বিদ্যুৎ না থাকায় সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় মোবাইলফোন অপারেটরের নেটওয়ার্ক বিকল হতে শুরু করেছে। বিভিন্নজনের নাম্বারে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। ইমার্জেন্সি পাওয়ার ব্যাকআপ বা আইপিএস সহ যাদের বাসায় ইন্টারনেট সংযোগ আছে, তেমন কয়েকজনকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় পেয়ে যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদক। মোবাইল নেটওয়ার্কের সমস্যার বিষয়টি তাদের কাছ থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে। জানা যায়, দুর্ঘটনা এড়াতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রেখেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। সুনামগঞ্জ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ তাদের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপের সময় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী স্নিগ্ধা রায় তুষ্টির কণ্ঠে ছিল অসহায়ত্ব। তিনি বলেন, সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। বৃষ্টি কমছে না। চোখের সামনে ঘরের ভেতর সব আসবাবপত্র ডুবে গেছে। যারা মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে চলেছেন, তাদের জন্য কার কাছে সাহায্য চাইব? প্রশাসন, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, আনসার, সবাই তো মানুষ! শুধু বন্যা নয়, প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টিও একমুহূর্তের জন্য রেহাই দিচ্ছে না।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রোগ্রাম অফিসার ও সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার বাসিন্দা আলমগীর শাহরিয়ার বলেন, উদ্ধার তৎপরতায় দ্রুত সেনাবাহিনী নামানো প্রয়োজন। বন্যাকবলিত এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। লোকজনের ফোনে চার্জ নেই। জেলা-উপজেলার সবগুলো সড়ক পানির নিচে। মানুষ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং বিপন্ন। কেউ বিপদে পড়লেও কারোর সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে দক্ষ উদ্ধারকারী দল মাঠে নামাতে হবে।
শিক্ষক রুনা শাহীন আরা লেইস বলেন, বাতাস প্রবল, সাথে বৃষ্টি মুষলধারায়, বজ্রপাতও। এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় কেউ কাউকে সাহায্য করতে যাবেই বা কী করে? বিদ্যুৎ নেই, ঘরে খাবার নেই, খাবার পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে। গ্যাস সংযোগ থেকেও নেই, কারণ অনেকের রান্নাঘরের চুলা পানিতে তলিয়ে গেছে।
সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত জানান, বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) সুনামগঞ্জ পৌর শহরের সব একতলা বাড়ি প্লাবিত হয়েছে। প্রতিটি গলিতে এখন নৌকা চলছে। একতলা বিশিষ্ট দোকানপাট প্লাবিত হয়ে নিত্যপণ্য ও ওষুধসহ নানা পণ্যের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। মানুষ উঁচু ভবন খুঁজে খুঁজে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে। ভয়াবহ দুর্যোগে পড়েছেন সুনামগঞ্জের মানুষ। ঝড়বৃষ্টি থামছে না।
এর আগে বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) সকাল থেকেই পানি বাড়তে থাকায় অনেকেই বাসা থেকে বের হতে পারেননি। জরুরি প্রয়োজনে যারা বের হয়েছেন তাদের প্রায় সকলকেই কোমর পানি মাড়িয়ে চলাচল করতে হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে চাকরিজীবী ও স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা দাবি করেছেন, সুনামগঞ্জকে বন্যা দুর্গত এলাকা ঘোষণা করে যেন সাধারণ ছুটি দেওয়া হয়। এসএসসি পরীক্ষা পেছানোরও দাবি উঠেছে।
সুনামগঞ্জে জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা বা বন্যা কবলিতদের উদ্ধারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তা জানার জন্য সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।